ইসরাইলি হামলায় ‘লেবাননের বন্দী ডিন’ নিহত, ক্ষুব্ধ হিজবুল্লাহ
মো: কামরুজ্জামান বাবলু ঃ ইসরাইলের বিমান হামলায় লেবাননের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহর অন্যতম শীর্ষ নেতা সামির কান্তার নিহত হয়েছেন। রোববার সকালে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের নিকটে একটি ভবনে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে এই কমান্ডারকে ইসরাইল হত্যা করেছে বলে দাবি হিজবুল্লাহর। ইসরাইলের কারাগারে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে বন্দী থেকে “dean of Lebanese prisoners” অর্থাৎ “লেবাননের বন্দী ডিন” হিসেবে পরিচিত এই শীর্ষ নেতাসহ হামলায় আরও আটজন নিহত হয়েছেন বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়।
এদিকে, হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, যায়নবাদি শত্রুরা বিমান থেকে বোমা হামলা চালিয়ে জারামানায় যে ভবনে সামির কান্তার বাস করতেন তা ধ্বংস করে দিয়েছে।
এদিকে, সিরিয়ার সরকারি টেলিভিশনের এক খবরে বলা হয়, “সন্ত্রাসী হামলায়” কান্তার নিহত হয়েছেন। তবে হামলাটি কারা চালিয়েছে সে ব্যাপারে চ্যানেলটির প্রতিবেদনে সুস্পষ্টভাবে কিছু বলা হয়নি।
এদিকে, কান্তার মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করে তার ভাই বাসসাম কান্তার সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম টুইটারে দেয়া এক বার্তায় বলেন, কমান্ডার সামির কান্তার হত্যার ঘটনায় আমরা মর্মাহত। তবে, আমরা গর্বিত, কারণ এতদিন পর্যন্ত আমরা ৩০ বছর বন্দী থাকা একজন মুজাহিদের পরিবারের সদস্য হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলাম। আর এখন থেকে আমরা একজন শহীদের পরিবারের সদস্য হওয়ার গৌরব অর্জন করলাম।
সামির কান্তার হচ্ছেন একমাত্র আরব বন্দী যিনি ইসরাইলের কারাগারে সর্বোচ্চ ৩০ বছর পর্যন্ত বন্দী ছিলেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সের তরুন কান্তার ১৯৭৯ সালে ফিলিস্তিনি লিবারেশন ফ্রন্টের (Palestine Liberation Front) একজন সদস্য হিসেবে লেবানন থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইসরাইলের নাহারিয়া অঞ্চলের একটি গ্রামে ঢুকে পড়েছিলেন। সেই দু:সাহসিক অভিযানকালে কান্তার তার অপর তিন সহযোগীসহ ইসরাইলি সেনাদের হাতে বন্দী হন।
এরপর থেকেই ইসরাইলের কারাগারে আটক কান্তারকে পাঁচ দফায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। শুধু তাই নয় ইসরাইলি পুলিশ সদস্য ড্যানি হারান এবং তার চার বছরের মেয়ে আইনাতকে হত্যার অভিযোগে কান্তারকে অতিরিক্ত আরও ৪৭ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। তবে, মেয়ে ও তার পিতাকে হত্যার অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে কান্তার।
এদিকে, ইসরাইলি নাগরিক ড্যানি হারান ও তার মেয়েকে হিজবুল্লাহ কমান্ডার কান্তার হত্যা করেছে বলে যে অভিযোগ ইসরাইল করছে তার সত্যতা নিয়ে ব্যাপক সংশয় দেখা দিয়েছে।
আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই হারানের স্ত্রী স্মাদার এক সময় তার দুই বছরের অপর এক কন্যা ইয়েলকে কান্না থামাতে গিয়ে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলেন। এটাকে তখন দুর্ঘটনা হিসেবে চালানো হয়েছিল। আর ওই ঘটনায় হারানের গোপন আস্তানাও প্রকাশ হয়ে পড়ে।
ইসরাইলি হামলায় নিহত হিজবুল্লাহ নেতা কান্তার ২০০৮ সালে ইসরাইলের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। ইসরাইলের সাথে হিজবুল্লাহর এক বন্দী বিনিময়ের আওতায় তাকে মুক্তি দিয়েছিল ইসরাইল। মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরলে লেবাননের রাজধানী বৈরুতের বিমানবন্দরে এক বীরোচিত সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল তাকে।
২০০৮ সালের জুলাই মাসে আলজাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে কান্তার বলেছিলেন, যেই অপারেশনের দায়ে তাকে সাজা দেয়া হয়েছিল সেই অপারেশনের টার্গেট ছিল ইসরাইলি সামরিক এবং বেসামরিক আস্তানা।
তবে, কোন বেসামরিক লোক ওই টার্গেটের লক্ষ্য ছিল না দাবি করে কান্তার তখন বলেছিলেন, যায়নবাদী ইহুদিদের একটি কুটকৌশল হলো বছরের এগারই মাসই যে ছুটিতে থাকে এমন সাধারণ নাগরিকদেরও অনেক সময় সেনা সদস্য হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রতিপক্ষের ওপর দোষ চাপানোর অপচেষ্টা চালানো হয়।
লেবাননের অপর চার নাগরিকসহ মুক্তি পাবার পর কান্তারকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন, লেবাননের প্রেসিডেন্ট মাইকেল স্লেইমান। এ সময় দেশটির অপরাপর বিশিষ্ট নাগরিকরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া সামির কান্তারের সম্মানে বৈরুতের দক্ষিনের প্রদেশ দাহিয়াহতে এক গণসংবর্ধনার আয়োজন করেছিল হিজবুল্লাহ। সেখানে সংগঠনটির নেতা হাসান নাসরুল্লাহ কান্তারকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন।
এরপর থেকেই সর্বমহলে এই বিশ্বাস জন্মে যে, তখন থেকেই হিজবুল্লাহর উচ্চ পর্যায়ের কমান্ডার হিসেবে কান্তার ভূমিকা পালন করবেন।
দ্রুজ সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা কান্তারের ব্যাপারে ধারনা করা হয়-সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আর আসাদের সমর্থনে দক্ষিণ সিরিয়ায় জাতীয় প্রতিরক্ষা শক্তি (National Defence Forces) নামে গঠিত আধা-সামরিক বাহিনীতে সিরিয়ার দ্রুজ সম্প্রদায় থেকে সদস্য রিক্রুট করার ক্ষেত্রে কান্তারের মুখ্য ভূমিকা ছিল।
এদিকে, বিবিসির এক খবরে বলা হয়, হিজবুল্লাহ কমান্ডার কান্তারের নিহত হওয়ার ঘটনাকে স্বাগত জানিয়েছে ইসরাইল। তবে, এ ঘটনায় নিজেদের দায় স্বীকার বা অস্বীকার কোনটাই করেনি ইসরাইল।
দেশটির নির্মান ও আবাসন মন্ত্রী ইয়োভ গ্যাল্যান্ট এক রেডিও সাক্ষাতকারে বলেন, আমি কান্তার হত্যার দায় স্বীকার বা অস্বীকার কোনটাই করছি না। তবে, সামির কান্তারের মতো কোন মানুষের এই পৃথিবীর অংশ হিসেবে বেঁচে থাকা ঠিক না। তাই এটা একটা সুখবর।
গত সেপ্টম্বরে আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের এক বিবৃতিতে কান্তারকে সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে বলা হয়, তিনি হিজবুল্লাহর সবচেয়ে দৃশ্যমান ও জনপ্রিয় মুখপাত্র (most visible and popular spokesman)।