হুকুমদাতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে
স্টাফ রিপোর্টারঃসাধারণ মানুষকে জিম্মি করে মঙ্গল ও বুধবার সড়ক অবরোধ ও নৈরাজ্যের মাধ্যমে পরিবহন শ্রমিকদের দেশ অচলের ঘটনায় ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছেন ইন্ধনদাতারা। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন- দায়ী যেই হোক না কেন, অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এরই অংশ হিসেবে রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকায় পুলিশের গাড়িসহ বিভিন্ন যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপের ঘটনায় ইতিমধ্যে চারটি মামলা হয়েছে। ৪০ জনের নামসহ প্রায় ১২০০ জনকে করা হয়েছে আসামি। তাদের মধ্যে রয়েছে বাসচালক, হেলপার ও এ স্তরের বেশ ক’জন শ্রমিক নেতার নাম।
তবে দেশ অচল করে দিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যারা শ্রমিকদের উসকে দিয়েছেন এবং যাদের বৈঠক থেকে আন্দোলনের ডাক সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, সেসব প্রভাবশালী নেতার নাম নেই সম্ভাব্য আসামির তালিকায় অথবা তাদের জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারেও মেলেনি উচ্চপর্যায়ের কোনো ‘সবুজ সংকেত’।
আর এ কারণেই তাদের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত ‘নীরব দর্শক’-এর ভূমিকায় রয়েছে আইনশৃংখলা বাহিনী। তবে ইতিমধ্যে এসব নেপথ্য নায়কদের চিহ্নিত করে তাদের ভূমিকার ওপর বিস্তারিত প্রতিবেদন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে জমা দিয়েছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা।
এদিকে দু’জন বাসচালকের সাজার রায়ের বিরুদ্ধে সারা দেশে পরিবহন খাতে অরাজক ও নৈরাজ্য সৃষ্টির নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনরা।
তারা বলেছেন, আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে যারা আন্দোলনের নামে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে, পুলিশের গাড়ি ও বক্সে অগ্নিসংযোগ করেছে এবং ঘটনার ইন্ধনদাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। অন্যথায় এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটতে থাকবে। সাধারণ মানুষকে আবারও দুর্ভোগ পোহাতে হবে। আর সরকারকেও পড়তে হবে বেকায়দায়।
এমন আশংকা প্রকাশ করে তারা আরও বলেন, অতীতে যে কোনো সহিংসতায় ইন্ধনদাতা হিসেবে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের ফৌজদারি মামলায় হুকুমের আসামি করা হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।
সাধারণ শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতার করা হলেও শ্রমিক ও মালিক সংগঠনের প্রভাবশালী নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। গত সপ্তাহে সারা দেশে পরিবহন ধর্মঘটের নামে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল মূলত পরিবহন শ্রমিক ও মালিকদের শীর্ষ সংগঠনগুলোর তত্ত্বাবধানে।
তবে পরিবহন ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে পুরো ঘটনা প্রধানমন্ত্রী অবগত রয়েছেন বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। শুক্রবার টেলিফোনে যুগান্তরকে তিনি বলেন, পরিবহন ধর্মঘট নিয়ে গোয়েন্দাদের প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কাছে রয়েছে। তিনি সবই দেখছেন।
পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানান, মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ পাঁচজনের প্রাণহানির মামলায় বাসচালক জামির হোসেনের যাবজ্জীবন সাজা বাতিলের দাবিতে প্রথমে চুয়াডাঙ্গা ও পরে খুলনার ১০ জেলায় পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়। ওই ধর্মঘটের ঘোষণা দেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সিনিয়র সহসভাপতি আবদুর রহিম বক্স দুদু। এ সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান।
ওই ধর্মঘট নিয়ে নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের বাসভবনে বৈঠকে বসেন মালিক-শ্রমিক নেতারা। বৈঠক চলাকালে সেখানে খবর যায় সাভারে ট্রাকচাপা দিয়ে এক নারীকে হত্যার দায়ে এক ট্রাকচালকের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত। এরপরই ধর্মঘট প্রত্যাহারের কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়।
বৈঠক শেষে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা ফোনে আঞ্চলিক নেতাদের ধর্মঘট পালনের নির্দেশ দেন। ওই ধর্মঘট চলাকালেই গাবতলীতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। বিভিন্ন জেলায় সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েন শ্রমিকরা।
শ্রমিক ফেডারেশনের সিনিয়র সহসভাপতি আবদুর রহিম বক্স দুদুর ভাষ্য অনুযায়ী, শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি ওয়াজিউদ্দিন খান ও সাধারণ সম্পাদক দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। তাদের অসুস্থতার কারণে নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের সঙ্গে পরামর্শ করে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ধর্মঘট প্রত্যাহারের পর যুগান্তরকে এসব তথ্য জানিয়েছিলেন তিনি।
আর ধর্মঘট চলাকালে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান শ্রমিকদের পক্ষ নিয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন। ধর্মঘটের পক্ষে সাফাই গেয়ে তিনি বলেন, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা ক্ষোভ প্রকাশ করতেই পারেন। আপনিও করেন, আমিও করি। ঠিক একইভাবে ওরাও (শ্রমিকরা) ক্ষোভ প্রকাশ করছে। তিনি আরও বলেন, চালকরা মনে করছেন তারা মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিয়ে গাড়ি চালাবেন না। তাই তারা স্বেচ্ছায় গাড়ি চালাচ্ছেন না। এটাকে ধর্মঘট নয়, স্বেচ্ছায় অবসর বলা যেতে পারে।
এদিকে পরিবহন ধর্মঘটের নেপথ্যে সরকারের মন্ত্রী পর্যায়ের ব্যক্তিরা ইন্ধনদাতা হলেও তাদের আইনের আওতায় না আনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন।
তিনি যুগান্তরকে বলেন, শাজাহান খানসহ সরকারের বিভিন্নজন তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন করেছেন। পরিবহন ধর্মঘটের পেছন থেকে যারা ইন্ধন জুগিয়েছে, তাদের অ্যারেস্ট না করে সাধারণ শ্রমিকদের আটক করা হচ্ছে, এটা বড় অন্যায়। অথচ বিগত দিনে দেখা গেছে, হরতাল, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে ইন্ধনদাতা বা হুকুমের আসামি করে ক্রিমিনাল কেস করা হয়েছে। এবার তা দেখা যাচ্ছে না। পরিবহন নৈরাজ্যের গোড়ায় যারা ছিল তাদের ধরতে হবে।
তিনি বলেন, সরকারের মন্ত্রী বা অন্য যারা এ ঘটনার পেছন থেকে কাজ করেছেন তারা আরামে আছেন। তবে এ আরাম বেশি দিন থাকবে না। তাদের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি হচ্ছে, কিছু একটা হবে।
তবে নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার সুযোগ এখনও রয়েছে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। তিনি বলেন, গাবতলী বাস টার্মিনালে যারা গাড়ি ভাংচুর, পুলিশের গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। কয়েকজনকে আটকও করা হয়েছে। আটক ব্যক্তিদের বক্তব্য থেকে জানা যাবে, এ ঘটনার নেপথ্যে কারা ছিলেন। তাদের বক্তব্যে যাদের নাম আসবে, হোক সে মন্ত্রী, তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন- কোথায়, কার বাসায় মিটিং করে পরিবহন ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তা সবারই কম-বেশি জানা। যারা সরকারের ভেতরে থেকে সরকারকে বিপদে ফেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের আইনের আওতায় অবশ্যই আনা উচিত। তিনি বলেন, শুধু দুর্বলের ওপর আইনের প্রয়োগ করলে হবে না। চূড়ান্ত বিচারে দুষ্টচক্রকেও আনতে হবে। পরিবহন সেক্টরে এ ধরনের অরাজক পরিস্থিতি সহ্য করা রাষ্ট্রের জন্যও সমীচীন নয় বলে মনে করেন তিনি।
পরিবহন খাতে নৈরাজ্যের নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া না হলে আবারও বিশৃংখল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন সুশাসনের জন্য নাগকির (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনের নেপথ্যে যাদের নাম এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার লক্ষণ দেখছি না। এতেই আইনের শাসনের দুরবস্থার বিষয়টি স্পষ্ট। সিলেকটিভ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, অতীতে সহিসংতার ঘটনায় রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অথচ সারা দেশ অচল করে পুলিশের ওপর হামলা, রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স ভাংচুরসহ তাণ্ডবের ঘটনার হুকুমদাতাদের নাম মামলায় উল্লেখ করা হল না।
সুজন সম্পাদক বলেন, পরিবহন নৈরাজ্যের ঘটনার নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। নইলে আবারও বিশৃংখল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এতে সরকারের ইমেজ নষ্ট হবে।
সরকারকে বার্তা দিলেন শ্রমিকরা : পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দু’জন চালকের রায়কে কেন্দ্র করে পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হলেও মূলত লক্ষ্য ছিল মালিক-শ্রমিক সংগঠনের শক্তির বার্তা সরকারকে দেয়া।
কারণ হিসেবে তারা বলেন, সামনে দুটি বড় বিষয় রয়েছে। প্রথমত. সড়ক পরিবহন আইনটি চূড়ান্ত রূপ নিচ্ছে। ওই আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় চালকের সাজা কী হবে তা নির্ধারিত থাকবে। অপরটি ঢাকা শহর থেকে ২০ বছরের পুরনো বাস তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত।
তারা জানান, অধিকাংশ পুরনো বাস ক্ষমতাসীনদের তত্ত্বাবধানেই পরিচালিত হচ্ছে। এগুলো থেকে নিয়মিত মাসোয়ারা আদায় করা হয়। ওইসব গাড়ি উঠিয়ে দেয়া হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেন, পুরনো বাস বন্ধের বিরুদ্ধে সরকারকে ভয় দেখাল শ্রমিক-মালিকরা। বুঝিয়ে দিল- চাইলে তারা দেশ অচল করে দিতে পারে।
সূত্র: যুগান্তর