হজে গিয়েও প্রতারিত হচ্ছে হজযাত্রীরা
স্টাফ রিপোর্টারঃ ‘এ পর্যন্ত যা হয়েছে, সে জন্য আমি লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। আমাকে মাফ করে দেন। আজ থেকে এমন আর হবে না। বাকি দিনগুলো আপনারা যেভাবে চাইবেন সেভাবেই হবে।’
চরম অব্যবস্থাপনা ও প্রতারণার জন্য এভাবেই হজযাত্রীদের কাছে মাফ চেয়ে পার পেলেন দ্য সিটি ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূর মোহাম্মদ।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ- তিন লাখ ৬০ হাজার টাকা নিয়ে এ-ক্যাটাগরি, তিন লাখ টাকায় বি-ক্যাটাগরি ও ২ লাখ ৮০ হাজার টাকায় সি-ক্যাটাগরির (থাকা-খাওয়া) সুবিধা দেয়ার কথা থাকলেও সব হাজীকে একই হোটেলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রেখেছেন।
বাড়তি টাকার সুবিধা দেয়ার প্রতিশ্রুতি তো দূরের কথা হজযাত্রীদের একরকম জিম্মি করে রাখা হয়েছে। নানা বাধা-বিপত্তি ও অব্যবস্থাপনা অতিক্রম করে ঢাকা থেকে সৌদি আরবে পৌঁছার পর হজযাত্রীদের সেই হজ এজেন্সি সৃষ্ট নতুন নতুন সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
এদিকে হজের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে মক্কার পথে পথে মানুষের ঢল ততই বাড়ছে। সব পথ যেন গিয়ে মিশেছে কাবার দিকে।
১৬ স্কয়ার ফুটের একটি রুমে ৪-৫ জনকে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে। খাওয়ার পানি নেই, বাথরুমে টিস্যু নেই। রুমের ভেতর দুর্গন্ধ। পলিথিনে দেয়া হয় খাবার। অনেক সময় পচা ও দুর্গন্ধযুক্ত খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
বাসার ওয়াশরুমে ওজু করতে হলে সিরিয়াল ধরার কারণে মসজিদে জামাতে নামাজ ধরা যায় না। দু’দিন আগে এজেন্সি মালিক নূর মোহাম্মদ হাজীদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তোপের মুখে পড়েন।
বাড়তি সুবিধা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে হজযাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি অর্থ আদায় করে নিজের কাফেলায় যুক্ত করলেও মক্কা-মদিনায় তাদের জিম্মি করে রাখা হয়েছে। থাকা-খাওয়ার এ দুর্ভোগে ক্লান্ত শরীরে অনেকে হজপালন নিয়েই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন।
কথা হয় কয়েকজন হজযাত্রীর সঙ্গে। তারা বলেন, ৪৫ জনের জন্য একজন গাইড থাকার কথা থাকলেও গাইড খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কখন কোথায় যেতে হবে, কী করতে হবে, অনেকে তা জানেন না। অব্যবস্থাপনায় অনেকে নিজেদের লাগেজ পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছেন। কারও হ্যান্ডব্যাগ পাওয়া যাচ্ছে না, কারও বোর্ডিং কার্ড, কারও বা টিকিট হারিয়ে গেছে। কেউ আবার রিয়াল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন।
‘কাবার পথে’ নামের এক এজেন্সির মাধ্যমে সৌদি আসা মোহাম্মদ আলী নামের এক হজযাত্রীর হ্যান্ড লাগেজ এই প্রতিবেদকের রুমে পড়েছিল তিন দিন। পরে লাগেজটি হজ কাউন্সিলরের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। ঢাকার সাভার থেকে আসা হাফিজুর রহমান খান নাঈম নামের এক হজযাত্রীর অভিযোগ- দ্য সিটি ট্রাভেল এজেন্সি মহিলা-শিশুসহ তাদের ৪৫ জনকে মক্কায় এনেছে।
প্রত্যেকের কাছ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা করে নিলেও থাকা-খাওয়া খুবই নিন্মমানের। এসব খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সৌদি দূতাবাস ও মক্কা হজ অফিসে লিখিত অভিযোগ করেও কোনো কাজ হচ্ছে না। জানতে চাইলে হজ কাউন্সিলর অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, রীতিমতো অভিযোগের পাহাড় জমে গেছে।
জানতে চাইলে দ্য সিটি ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূর মোহাম্মদ বলেন, পুরো বিষয়টির জন্য আমি লজ্জিত। সূত্র বলছে, প্রতিবছরই হাজীদের মক্কা-মদিনায় এমন দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছে না।
জানা গেছে, কাবা শরিফ থেকে অনেক দূরে আঁকাবাঁকা গলিপথের ভেতরে থাকতে দেয়ায় অনেক হজযাত্রীকে পথ হারিয়ে দীর্ঘ সময় ঘোরাঘুরি করতে হচ্ছে।
ট্রাভেল এজেন্সির খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ায় অনেকে আবার নিষিদ্ধ হওয়ার পরও হোটেল কক্ষে রান্না করে খাচ্ছেন। বাংলাদেশের কনস্যুল জেনারেল (জেদ্দার হজ কাউন্সিলর) মাকসুদুর রহমান বলেন, অনেক অভিযোগ পেয়েছি, একজন অতিরিক্ত সচিব ও একজন যুগ্ম সচিব তদন্ত করছেন। আমরা নিজেরাও খতিয়ে দেখছি। এ ব্যাপারে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মক্কার কনস্যুল জেনারেল আবুল হাসান জানান, ধর্ম মন্ত্রণালয় হজ পালন নির্বিঘœ করতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। হাবকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
এরপরও যেসব এজেন্সি প্রতারণা ও ছলচাতুরী করছে তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া হবে না। শাস্তি দেয়ার পাশাপাশি এদের লাইসেন্সও বাতিল করা হবে।
কাবা শরিফ ঘিরে মানুষের কোলাহল বাড়তে শুরু করেছে। কারও সঙ্গে নেই কারও বিভেদ, লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ধ্বনিতে মুখর কাবা শরিফের চারপাশ।
এত অভিযোগ-আপত্তির পরও প্রায় ১৮০টি দেশের ৩০ লাখ মানুষ হজের জন্য প্রস্তুত। সোমবার দুপুর থেকে শুরু হয়েছে মিনায় যাওয়া। অনেক হজযাত্রী ইতিমধ্যে সেখানে পৌঁছেছেন।