ভোটারদের ভোট দেওয়ার আগ্রহ কমে যাচ্ছে
তোফায়েল আহমেদ ঃ জাতীয় নির্বাচনের জন্য যে আইন কার্যকর আছে, সেটা স্থানীয় নির্বাচনে অনেকটা প্রযোজ্য নয়। এটা একটা সীমাবদ্ধতা। দলের টিকিট না পেলে আইনত নির্বাচন করতে বাধা নেই। আগের আইন বহাল রেখেও দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অসুবিধা ছিল না। এটি ইসি আচরণবিধির মধ্যে সংযোজন করে নিতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে দলীয় প্রতীকে ভোট হয়, কিন্তু পঞ্চায়েত আইনে বলা নেই যে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হবে। আমরা আইন করে যেভাবে দলের কথা বলেছি, তার কোনো দরকার ছিল না।
দলের মধ্যে নীতি ও গণতন্ত্রের চর্চা নেই। দলীয় শৃঙ্খলা গণতন্ত্রচর্চার মাধ্যমেই বিকশিত হয়। এখন যা হচ্ছে তাতে হলো সমাজে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত একটা অর্ডার বা ধারা তৈরি করা, এর কোনো আইনি ভিত্তি নেই। পরোক্ষভাবে সংবিধানেরও লঙ্ঘন ঘটছে। কারণ, দল প্রার্থী দেবে, কিন্তু তাই বলে দলের অন্য কেউ দাঁড়াতে চাইলে তাঁর ওপর জোর খাটানো যাবে না। দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনের জন্য দল শাস্তি দেবে বা বহিষ্কার করবে। কিন্তু তাঁকে প্রতিহত করা যাবে না। ইসির উচিত ছিল আগ্রহী প্রার্থীদের সুরক্ষা দেওয়া, দল কী করবে সেটা দেখা তার কাজ নয়। এখানে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে অপারগতার দায় ইসিকে নিতে হবে। ইতিপূর্বে অনুষ্ঠিত উপজেলা ও মেয়র নির্বাচন থেকে অনেকেই শিক্ষা নিয়েছেন। প্রথমত, সরকারি দলের বিরুদ্ধে ভোট করতে অনেক ঝুঁকি। যাঁরা ঝুঁকি নিয়েও জিতে গেছেন, তাঁরা বিজয়ী হয়েও কাজ করতে পারছে না। কিংবা মামলা মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এসব দেখে ইউপিতে আর কেউ এই ভুল করছেন না। তারা আগে থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছেন একরকম নীরবে।
ইসিকে অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের কাছে যাওয়ায় একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তবে বাস্তবে তেমন কোনো সংকটে তারা এখনো পড়েনি। বরং সাম্প্রতিক কালে তারা জনগণ ও গণমাধ্যমের কাছ থেকে একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। এই নির্বাচনে আরও কতগুলো মন্দ নজির সৃষ্টি হয়েছে। যেমন একটা আইন ছিল, যেখানে ইসিকে একটা ক্ষমতা দেওয়া ছিল, যাতে তারা যে কারও প্রার্থিতা বাতিল করতে পারত, সেটা এখন আর নেই। ইসি ঝুঁকি নেবে না বলে তারাই নিজ গরজে দায়মুক্তি নিয়েছে, নাকি সরকার কেটে দিয়েছে, তা জানি না। এবারের ইউপি নির্বাচনেই প্রথম সেই ক্ষমতা ছাড়া ইসি ভোট পরিচালনা করবে।
ইতিহাসের স্থান ইতিমধ্যে নির্ধারিত হয়ে গেছে। কাদম্বিনীকে আর মরে প্রমাণ করতে হবে না। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিপুলসংখ্যক মানুষ নির্বাচিত হওয়ার বিষয়ে গণমাধ্যমসহ আমাদের সবাইকে নির্মোহভাবে সামাজিক এবং রাজনৈতিক-অর্থনীতির বিশ্লেষণে যেতে হবে। কেবল ইসির দিকে সব বিষয়ে অঙ্গুলি নির্দেশ করলে চলবে না। সংকটের প্রকার ও প্রকৃতি আরও অনেক গভীর, ভয়াবহ ও সুদূরপ্রসারী।
গ্রামে বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রাধান্যনির্ভর যে সালিসব্যবস্থা ছিল, সেটা এখন নেই। এখন সালিস-বিচার করেন উঠতি রাজনৈতিক নেতা বা কোনো ব্যবসায়ী বা উঠতি কোনো মাস্তান। এখন বৈধতার সংকটের ভেতর থেকে কেউ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরে তার গ্রহণযোগ্যতা আরও কমে যাচ্ছে। পরিষদ ব্যবস্থার সামাজিক ও রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ থাকবে।
নির্বাচন সব সময় গণতন্ত্রের জন্য হয় না। কখনো একনায়কতন্ত্রকে মহিমান্বিত করার জন্যও নির্বাচনের প্রয়োজন হয়। তাই নির্বাচন মানেই গণতন্ত্রচর্চা নয়। নির্বাচন গণতন্ত্রের সব গুণের সমষ্টি নয়। নির্বাচনকে যখন একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তখন সে নির্বাচন সে অনুযায়ী ফল বয়ে আনে। এ দেশে ১৯৯১ থেকে ২০০১— এ সময়ের মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচনের মোটামুটি একটি কাঠামো দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, মানুষের মনে নির্বাচনের ওপর আস্থা ফিরে এসেছিল। ২০১৪ থেকে পর্যায়ক্রমে আবার আমরা পেছনে ফিরছি।
যদিও আমাদের বড় দলগুলো কখনোই স্থানীয় সরকারকে গুরুত্ব দেয়নি। ইউপি দীর্ঘদিন (১৫০ বছর) ধরে ছিল একটা সামাজিক প্রতিষ্ঠান, তার সামাজিক সত্তার একটা সাধারণ গ্রহণযোগ্যতা ছিল। রাজনৈতিক ও উন্নয়ন সত্তা হিসেবে তার অধিষ্ঠান সাম্প্রতিক কালে। কিন্তু ধীরে ধীরে এ প্রতিষ্ঠান তার সামাজিক গুরুত্ব হারিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দলের এজেন্ট হয়ে গেছে। ফলে সরকারি বরাদ্দ বাড়লেও প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা, গ্রহণযোগ্যতা, ও নেতৃত্বের সততা ও নিষ্ঠা নিয়ে জনমনে বহু প্রশ্ন আছে।
‘গ্রাম আদালত’প্রকৃত আইনি অর্থে অকেজো ও মূল্যহীন। কিন্তু প্রকল্পের অর্থের স্যালাইন দিয়ে এটি ঠেকানো হচ্ছে। ইউএনডিপি ও ইইউর সহায়তায় এনজিওগুলো এর পেছনে আছে। অনেকেই গ্রাম আদালত কার্যকর করার চাকরি করছেন। এখানে একটা ভুল হচ্ছে। ইউপি যেখানে কার্যকর নয়, মরে যাচ্ছে, সেখানে বিদেশি অর্থে ইউপিতে গ্রাম আদালত কীভাবে কার্যকর হবে? এটা তো একটা স্ববিরোধিতা। পরিষদে ভালো নেতৃত্ব এলে তাঁরাই ন্যায্য সালিস-বিচার করবেন। এখন যেভাবে ভোট হতে যাচ্ছে তাতে এটা আরও গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। অনেক ক্ষেত্রে হয়তো যোগ্য লোকই মনোনয়ন পেয়েছেন এবং তাঁরাই জিতে আসবেন। কিন্তু দলীয় প্রতীক ও মনোনয়নের কারণে তাঁরা তাঁদের ভূমিকা বদলাবেন। তাঁরা এখন দলের ভাইসরয় হয়ে আসছেন।
সরকার ও বিএনপি উভয়ের ব্যর্থতা নয়। অপরাধ দুরকম। সরকার ও সরকারি দল আদর্শচ্যুত। তারা আদর্শের নতুন বয়ান দিয়ে যাচ্ছেন। সবাইকে ওই বয়ান গ্রহণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাধ্য করছেন। বিএনপি কাউন্টার ন্যারেটিভ বা পাল্টা বয়ান দিতে পারছে না। এটি বিএনপির শোচনীয় ব্যর্থতা। সরকার ও বিএনপি উভয়ের স্বার্থ অভিন্ন। মন পরিষ্কার নেই বলেই আদর্শের লড়াইয়ের তাড়া নেই। আদর্শের লড়াই না থাকলে দুদলের ক্ষমতার লড়াইয়ে জনগণ অংশ নেবে না। সামগ্রিক অনিয়ম–অব্যবস্থাপনা ও স্খলনের নিট ফল হচ্ছে গভীর হতাশা। ইউপি নয়, স্থানীয় সরকারব্যবস্থাই এখন অকেজো। মানুষ কেন ভোট দেবে। মার্চ স্বাধীনতার মাস বলে আরেকটি কথা বলি। যে অবস্থার ভেতর দিয়ে আমরা এখন যাচ্ছি, এটা একাত্তরে থাকলে স্বাধীনতাযুদ্ধ হতো কি না, আমার সন্দেহ আছে।
নির্বাচন উৎসব অবশ্যই হবে। তবে এটি ভিন্ন প্রকৃতির উৎসব। দলমত-নির্বিশেষ সবাই স্বীকার করবেন যে নির্বাচনী পরিবেশ, মানুষের মনমানসিকতা, ভোটারদের সক্রিয়তা কমেছে, বদলেছে। ভোটারের ভোট দেওয়ার আগ্রহ কমে গেছে। কারণ, নির্বাচিত ব্যক্তিদের কাছে মানুষ কিছু আশা করছে না। আর আমি ভোট দিলেই কেউ হবে, না দিলে হবে না—এ বিশ্বাসেও চিড় ধরেছে। ভোটের প্রতি মানুষের একটা অনীহা এসে গেছে। ভোটের রাজনীতিতে বিরাট একটা ঝোড়ো হাওয়া বয়ে গেছে। নেতিবাচকভাবে একে একটা গুণগত পরিবর্তন বলব। আসলে এই নির্বাচনকে আপনি বরং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার উৎসব বলতে পারেন! একসময় হতো কারচুপির ও জাল ভোটের নির্বাচন। তারপর কিছু নির্বাচন সুষ্ঠু হলো। আবার শুরু হলো ক্ষমতা প্রভাবিত নির্বাচন। সাম্প্রতিক কালে দ্রুতগতিতে ও সংখ্যায় বাড়ছে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন। নির্বাচনের এক নতুন গন্তব্য।
এ থেকে বেরোনোর জন্য মানুষের বিশ্বাস ফেরাতে যুগপৎ উদ্যোগ দরকার। একটি যুগ বা দু-একটি নির্বাচন সবকিছু নয়। প্রয়োজন হচ্ছে অবস্থার সঠিক বিশ্লেষণ ও সংকট কাটানোর সৎ উদ্যোগ। নাগরিক সক্রিয়তা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
তোফায়েল আহমেদ: মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিচালক এবং বিআইজিডি ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং ফেলো। (সূত্র: প্রথমআলো)