সব

এক নজরে বিজ্ঞানী ‘স্টিফেন হকিং’

AUTHOR: Primenews24bd Desk
POSTED: Wednesday 14th March 2018at 1:39 pm
137 Views

আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ যখন তার বয়স ছিল নয় বছর তখন তিনি ছিলেন ক্লাসের সর্বশেষ মেধাক্রমের ছাত্র অর্থাৎ পেছনের দিক থেকে প্রথম। তার ডাক নাম ছিলো আইনস্টাইন।

যদিও পরীক্ষায় কম পেতেন তবুও তাঁর বুদ্ধির তীব্রতায় শিক্ষকদের কাছে ছিলেন অত্যন্ত প্রিয়। বিজ্ঞান সর্ম্পকে আগ্রহের কারণে শিক্ষক আর বন্ধুরা আদর করে ডাকতেন আইনস্টাইন।

হুইল চেয়ারের বিজ্ঞানীর পুরো নাম স্টিফেন উইলিয়াম হকিং। শারীরিকভাবে অচল এবং এমায়োট্রুফিক ল্যাটারাল স্কেরোসিসে (এক প্রকার মটর নিউরন রোগ) আক্রান্ত হয়ে ক্রমাগতভাবে সম্পূর্ণ অথর্বতার দিকে ধাবিত হওয়া সত্ত্বেও বহু বছর ধরে তিনি গবেষণাকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন।

১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি স্টিফেন হকিংয়ের জন্ম অক্সফোর্ডে। তার বাবা ড. ফ্রাঙ্ক হকিং একজন জীববিজ্ঞান গবেষক। মা ইসাবেল হকিং একজন রাজনৈতিক কর্মী।

শিক্ষাজীবন

১৯৫০ সালে হকিংদের পরিবার হার্টফোর্ডশায়ারের সেন্ট অ্যালবাতে চলে যান। ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত হকিং সেন্ট অ্যালবার মেয়েদের স্কুলে পড়েন। সে সময় দশ বছর পর্যন্ত ছেলেরা মেয়েদের স্কুলে পড়তে পারত। স্কুলে তার রেজাল্ট ভালো ছিল কিন্তু অসাধারণ ছিল না। বিজ্ঞানে হকিংয়ের সহজাত আগ্রহ ছিল।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫৯ সালে তিনি প্রকৃতি বিজ্ঞানে সম্মান কোর্সে ভর্তি হন। প্রথম আঠারো মাস হকিংয়ের তেমন ভালো কাটেনি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। তিনি নিজকে জনপ্রিয়, বিজ্ঞ ও জ্ঞানী ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। অবশেষে তিনি সাফল্যের সঙ্গে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন।

১৯৬২ সালের অক্টোবরে অক্সফোর্ডের গ্র্যাজুয়েট স্টিফেন হকিং পা রাখেন ক্যামব্রিজের সুরম্য প্রাঙ্গণে। তিনি গবেষণার জন্য বেছে নেন মহাবিশ্বতত্ত্ব। মহাবিশ্বতত্ত্ব নিয়ে গবেষণার জন্য স্টিফেনকে আইনস্টাইনের ব্যাপক আপেক্ষিকতাবাদের চর্চা করতে হতো। গণিতের ভিতটা মজবুত না হওয়ায় তার কাজ সন্তোষজনকভাবে এগোচ্ছিল না। ঠিক সেই সময় স্টিফেনের দুরারোগ্য স্নায়ুবিক অসুখটি ধরা পড়ল যার নাম মটর নিউরন ডিজিজ। ডাক্তাররা স্টিফেনের মেয়াদ বেঁধে দিলেন দু’বছর। দুঃখ-ভরাক্রান্ত ও হতাশাগ্রস্ত স্টিফেন জীবনের প্রায় সব আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু লন্ডনের রয়েল সোসাইটির এক সভায় ফ্রেড ওয়েলের তত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করতে পারায় বিজ্ঞানীরা তার উচ্চ প্রসংশা করেন। একজন তরুণ গবেষক হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠা পান। স্কিয়ামার অধীনে পিএইচডিতে কর্মরত অবস্থায়ই মহাবিশ্ব সম্পর্কে গবেষণার ক্ষেত্রে হকিং সুনাম অর্জন করেছিলেন।

এরপর লন্ডনের এক সভা থেকে হকিংয়ের জীবনের মোড় ঘুরে যায়। কিংস কলেজের সেই সভায় রোজার পেনরোজ তার বক্তৃতায় কৃষ্ণ বিবরের কেন্দ্রে স্থান-কাল অনন্যতার ধারণা সম্পর্কে অবহিত করেন। পেনরোজের এই ‘অনন্যতার-ধারণা’ হকিংয়ের পিএইচডি লাভের পথ সুগম করে। অবশেষে তেইশ বছর বয়সে স্টিফেন হকিং নামের আগে ডক্টর লেখার অধিকার অর্জন করেন।

গবেষণার ক্ষেত্র

তত্ত্বীয় কসমোলজি আর কোয়ান্টাম মাধ্যাকর্ষ হকিংয়ের প্রধান গবেষণা ক্ষেত্র। ১৯৬০-এর দশকে ক্যামব্রিজের বন্ধু ও সহকর্মী রজার পেনরোজের সঙ্গে মিলে হকিং আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব থেকে একটি নতুন মডেল তৈরি করেন। এ মডেলের ওপর ভিত্তি করে ১৯৭০-এর দশকে হকিং প্রথম তাদের তত্ত্বের প্রথমটি প্রমাণ করেন। এটি পেনরোজ-হকিং তত্ত্ব নামে পরিচিত। এই তত্ত্বগুলো প্রথমবারের মতো কোয়ান্টাম মহাকর্ষে এককত্বের পর্যাপ্ত শর্তসমূহ পূরণ করে। আগে ভাবা হতো এককত্ব কেবল একটি গাণিতিক বিষয়। এই তত্ত্বের পর প্রথম বোঝা গেল এককত্বের বীজ লুকানো ছিল আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বে।

বিবাহ জীবন

মটর নিউরোন রোগটি ধরা পড়ার বেশ কিছু আগে হকিংয়ের সঙ্গে জেন উইলডের দেখা হয়। ১৯৬৫ সালের ১৪ জুলাই স্টিফেন ও জেনের বিয়ে হয়। জেনের উপস্থিতি স্টিফেনকে আবার নতুন করে বাঁচতে অনুপ্রাণিত করেছিল। এ দম্পতি দুটি পুত্র ও একটি কন্যাসন্তানের জনক-জননী হন।

জেন ও হকিংয়ের ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর ১৯৯৫-এর সেপ্টেম্বরে হকিং তার নার্স মেসনকে বিয়ে করেন। দশ বছর সংসারের পর ২০০৬-এ হকিং ও মেসনের ছাড়াছাড়ি হয় এবং স্টিফেনের সঙ্গে জেনের সম্পর্ক আবার গভীরতর হয়।

ধর্মে বিশ্বাস

নিজের বই বা বক্তৃতায় নানা প্রসঙ্গে হকিং ‘ঈশ্বর’ শব্দটি ব্যবহার করেন। তার স্ত্রীসহ অনেকে তাকে একজন নাস্তিক হিসেবে বর্ণনা করলেও হকিং নিজে মনে করেন তিনি ‘সাধারণ অর্থে ধার্মিক নন’। তিনি বিশ্বাস করেন, ‘দুনিয়া বিজ্ঞানের নিয়ম মেনেই চলে।’ এমন হতে পারে নিয়মগুলো ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন কিন্তু নিয়মের ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য হস্তক্ষেপ করেননি।

প্রকাশনা

শারীরিক অবস্থার অবনতির সঙ্গে সঙ্গে হকিংয়ের বুদ্ধিমত্তা বিকশিত হতে থাকে। তিনি তার সব গবেষণালব্ধ ধারণা লিপিবদ্ধ করেন, ‘এ ব্রিফ স্টোরি অফ টাইম’ নামক গ্রন্থে। এ বইটি প্রায় এক মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে এবং সব বেশি বেশি বিক্রীত বইয়ের স্বীকৃতি অর্জন করেছে। এ বইটি পঞ্চাশেরও বেশি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। ১৯৯৩ সালে হকিং ‘ব্ল্যাক হোলস অ্যান্ড বেবি ইউনিভার্স অ্যান্ড আদার এসেইস’ নামক বইটি লিখেছেন। যেখানে তিনি তার বৈজ্ঞানিক চিন্তাচেতনা ও ব্যক্তিগত জীবনের কিছু অংশ তুলে ধরেন। ১৯৯৬ সালে তিনি স্যার রজার পেনরোজকে সঙ্গে নিয়ে ‘দ্যা নেচার অব স্পেস অ্যান্ড টাইম’ নামের বইটি লিখেন। তার পরবর্তী বছরে তারা দুজন আরেকটি বই লিখেন যার নাম ‘দ্যা লারজ, দ্যা স্মল অ্যান্ড দ্যা হিউম্যান মাইন্ড’। এভাবে সবক্ষেত্রে, সব পর্যায়ে তিনি ব্যাপক স্বীকৃতি অর্জন করেন।

সম্মাননা

২০০৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বীয় কসমোলজি কেন্দ্রে হকিংয়ের একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়। ২০০৮ সালের মে মাসে হকিংয়ের আরেকটি আবক্ষ মূর্তি উন্মোচন করা হয় দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে অবস্থিত আফ্রিকান ইন্সটিটিউট অব ম্যাথমেটিক্যাল সায়েন্সের সামনে। মধ্য আমেরিকার দেশ এল সালভাদর তাদের রাজধানী সান সালভাদরে বিজ্ঞান জাদুঘরটির নাম হকিংয়ের নামে রেখেছে।

শেষকথা

যখন বিজ্ঞানী হিসেবে স্টিফেন হকিংয়ের খ্যাতি বৃদ্ধি পাচ্ছিল তখন ভাগ্য তাকে তেমন পুরস্কৃত করেনি। ত্রিশ বছর বয়স থেকে কেবল মাথা ও হাতের সীমাবদ্ধ নড়াচড়া ছাড়া পুরো শরীরের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারিয়ে তিনি হুইল চেয়ারে বন্দি হলেন। তিনি শুধু কম্পিউটারের কণ্ঠ সংশ্লেষণ পদ্ধতিতে কথা বলতে পারেন যা তার সংবাদকে শব্দে পরিণত করতে পারে। কিন্তু এরকম ভয়াবহ শারীরিক অক্ষমতা তাকে দমাতে পারেনি। কম্পিউটার ব্যবহার করে গবেষণার কাজ চালানো এবং বক্তৃতা প্রদানে তিনি এখনও এক অবিশ্রান্ত কর্মী। তার শারীরিক সমৃদ্ধির জন্য একটি আমেরিকান সংস্থা তাকে চব্বিশ ঘণ্টার সেবা সুবিধা প্রদান করছে।

স্টিফেন হকিংয়ের সেরা কিছু উক্তি
* জীবনকে কখনও কখনও কঠিন মনে হলেও তা থেকে কোনো না কোনো সাফল্য অর্জন সম্ভব।

* আকাশের তারার দিকে তাকান, নিচের দিকে নয়। বিস্ময়কর মহাবিশ্বকে অনুভব করুন কৌতূহল নিয়ে।

* আপনি যদি সবসময় রাগম্বিত থাকেন আর অভিযোগকারী হন- তাহলে কেউ আপনার জন্য সময় বরাদ্দ করবে না।

* পরিবর্তনের জন্য অন্যতম সামর্থ্য হচ্ছে বুদ্ধিমত্তা।

* জীবনে কোনো মজা না থাকলে এটা দুঃসময় হয়ে উঠতে পারে।

* আমরা এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত- ঠিক বিশাল ব্রেনের নিউরনের মতো।

* শারীরিকভাবে অক্ষমদের প্রতি আমার উপদেশ- আপনার কাজের প্রতি মনোযোগ দিন, অক্ষমতা আপনাকে আটকাবে না। শারীরিকভাবে পঙ্গুত্ব থাকতে পারে, মানসিকতা দিয়ে সেটিকে জয় করতে হবে।


সর্বশেষ খবর