আসামির শরীরে স্টিকার লাগিয়ে হাজির করা বেআইনি বললেন আদালত
উজ্জ্বল রায়, নড়াইল প্রতিনিধিঃ ভোলার সহকারী জজ জাবেদ ইমাম ২০১২ খ্রিস্টাব্দে ৩৪২ বোতল ফেনসিডিলসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ওই ঘটনায় তার চার বছর জেল হয়। কিন্তু জাবেদ ইমামকে গ্রেপ্তারের পর মিডিয়ার সামনে আসামির শরীরে স্টিকার লাগিয়ে হাজির করাকে বেআইনি বলে মত দেন আদালত।
১২ ডিসেম্বর ২০১২ প্রকাশিত সকল দৈনিক পত্রিকায় এদত সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হয়।
সাধারণত ফৌজদারি আইনে কেউ চূড়ান্ত দোষী সাব্যস্থ না পর্যন্ত অপরাধী বিবেচনা করার সুযোগ নাই। বরং বিচার চূড়ান্তভাবে নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ ধরে নিতে হবে। মামলা বিচারাধীন সময়ে অভিযুক্ত হিসাবে বিবেচিত হবে। কিন্তু সম্প্রতি অভিযুক্তদের মিডিয়ার সামনে এমনভাবে হাজির করা হয়, যেন তাদের নামে রায় দেওয়া হয়েছে। সরাসরি চোর, ডাকাত, খুনি স্টিকার লাগিয়ে আসামি হাজির করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। যা অস্বাভাবিক ও বেআইনি। বরং আইনে রায় দেওয়ার পর দোষী সাব্যস্থ হলে কারাগারে পাঠানো ছাড়া, কোন মিডিয়ায় উপস্থাপনের সুযোগ নেই। নিশ্চয়ই আমাদের ভেবে দেখা উচিত, পান সুপারি চুন জব্দ করব কিনা পরীক্ষার এ দুনিয়ায় ভুল করাটা অপরাধ নয়। অপরাধ হল, ভুল করার পর তা স্বীকার না করা (সালমান রুশদী ও মিছিলের রাজনীতি, মওলানা ওয়াহিদুদ্দীন খান, পৃষ্ঠা ১৭৪)। এই প্রবণতা বর্তমানে প্রবল আকার ধারণ করেছে। কেউ ভুল স্বীকার করতে চায় না। ভুল স্বীকার করলে নিজেকে ছোট বা দুর্বল মনে হয়। যে পান্ডিত্য প্রচারে ভুল হয়েছে, ওই পান্ডিত্য খন্ডন হয়ে যায়। ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক। ভুল শোধরানোও স্বাভাবিক। ভুল না শোধরিয়ে টিকেয়ে রাখা মূর্খতা বইকি।
নানা মহলের সূত্র থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যারা এড়িয়ে চলে, তারা প্রকৃত পক্ষে ঠিক লাইনে আছে কিনা এটি সন্দেহ। কিন্তু যাদের গাঁ ঘেষে চলে, তারা তাদের কতটা গুরুত্ব দেয় এটিও ভেবে দেখা উচিত এড়িয়ে চলাদের। সম্প্রতি গণমাধ্যমে ভুল শব্দের ব্যবহার লক্ষণীয় মাত্রায় বেড়েছে।
সোহেল রানা নামে একজন অগ্নিনির্বাপককর্মী নিহত হয়েছেন। বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুন নেভানোর ঘটনায় তিনি আহত হয়েছিলেন। ইংরেজি শব্দকে বাংলায় ব্যবহারের ক্ষেত্রে মোটাদাগে সব গণমাধ্যম ফায়ারম্যান ব্যবহার করেছে। যেন ফায়ারম্যান শব্দের বিপরীতে ফায়ার লেডি নামে আরেকটি শব্দ রয়েছে। কিংবা ফায়ার সার্ভিসে কেবল পুরুষ চাকরি করে। কোনো নারী চাকরি করলে তার পদও ফায়ারম্যানই থাকবে। টেলিভিশন ও রেডিওতে আগে সংবাদ পাঠক পাঠিকা শব্দ ব্যবহার করা হতো। এখন মোটাদাগে নারী পুরুষ বিবেচনা না করে নিউজ প্রেজেন্টার শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে। একই রকমভাবে জেন্ডার বান্ধব শব্দ হিসাবে ফায়ার ফাইটার শব্দ ব্যবহার হচ্ছে। এখন কেউ সেলসম্যান বা সেলস উইমেন শব্দ ব্যবহার করে না। বরং জেন্ডার বান্ধব শব্দ হিসাবে সেলস এক্সিকিউটিভ শব্দ ব্যবহার করে। এগুলো আধুনিকতা ও উন্নত রুচীরও পরিচয়। বর্তমানে ছাত্র ছাত্রী শব্দের ব্যবহার কমেছে। জেন্ডার বান্ধব বিবেচনায় শিক্ষার্থী শব্দের ব্যবহার বেড়েছে। প্রায় প্রতিদিন কতগুলো মেইল পাঠ করি সংবাদ সম্পাদনার কারণে। যারা আমাদের সঙ্গে যুক্ত তারা এখনও সকলে পরিহারযোগ্য সব শব্দ পরিত্যাগ করেছে এমন নয়। আবার আমরাও তাদের ব্যবহার করা শব্দ সব বাছাই করে পরিত্যাগ করতে পারি এমনও নয়। নানা কারণে অপব্যবহার হয় এমন শব্দ থেকে যায়। হয়তো সামনের দিনগুলোতে ব্যবহারিক উন্নতি হলে এসব আপদ দূর করতে পারব। আবার আমরা কতগুলো লাইন বা প্যারা সরাসরি বাতিল করে দেই। এটি আমাদের সম্পাদনা ছুরি এমন মনে করার কোন কারণ নেই।
সম্প্রতি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেসব প্রেস রিলিজ প্রেরণ করে এসব একটু ঘেঁটে দেখলেই মনে হবে কেন জানি অপ্রেয়োজনীয় অনেক বিষয় যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। যেমন দুই পক্ষ জমি সংক্রান্ত বিরোধে মারামারি করার কারণে মামলা হয়েছে। ওই মামলার পলাতক থাকা আসামিদের কোন একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার করেছে। এবার তারা আসামিদের মিডিয়ার সামনে হাজির করার সময়, আসামিদের ব্যবহার করা দুই বা তিনটি মোবাইল ফোন হাজির করেছে। এসব মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে বলে প্রেস রিলিজে উল্লেখ করা হয়েছে।
মারামারির মামলায় মোবাইল ফোন জব্দ না হলে, আসামি গ্রেপ্তারের পর মোবাইল ফোন জব্দ করা জরুরি কি? মোবাইল নামের যন্ত্রটি যেভাবে মানুষের ব্যবহারে প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠেছে, তাতে একজন আসামির নিকট মোবাইল ফোন থাকা স্বাভাবিক নয় কি? যে মোবাইল ফোন জব্দ হয়েছে এই ফোন কি মারামারিতে ব্যবহার হয়েছে? এই মোবাইল ফোন কি আদালতে সাক্ষ্য হিসাবে ব্যবহার করার মতো কোন আলামত? যদি আলামত না হয়ে থাকে, তাহলে এটি কোন কারণে প্রাসঙ্গিক? যার নিকট থেকে মোবাইল ফোন পাওয়া যায়, তার নিকট ২০-৫০ টাকাও পাওয়া যাওয়ার কথা। সব আসামির ক্ষেত্রে কি সামান্য কয়েক টাকাও জব্দ করা হয়? এখনও এই দেশে মানুষ যে পরিমাণ ধূমপান করে বা পান সুপারি খায়, তাতে কি এসবও জব্দ করার মতো? চোরাই পণ্য জব্দ ও নিত্য ব্যবহার্য যন্ত্র জব্দ কি একই ব্যাপার? ছিনতাইকারী, ডাকাত, চোর যদি মোবাইল ফোন চুরি, ডাকাতি বা ছিনতাইয়ে ব্যবহার করে তবে তা জব্দ হতে পারে। ধর্ষণকারীরও মোবাইল ফোন থাকতে পারে। যদি ওই মোবাইল ফোনে আপত্তিকর দৃশ্য ধারণ করা হয়, তাহলে নিশ্চয়ই মোবাইল ফোন জব্দ করা জরুরি। বিনা কারণে ধর্ষণে অভিযুক্ত ব্যক্তির মোবাইল ফোন আসামি সঙ্গে জব্দ হিসাবে কি কাজে আসবে? আসামিকে মিডিয়ায় হাজির করার সময় যন্ত্রপাতি সাক্ষ্য বা আলামত না হলে আদালতের নিকট কি এটি প্রযোজ্য? সাক্ষ্য আইনে বা ফৌজদারি কার্যবিধির কোন ধারায় এটি জব্দ করার বিধান রয়েছে বোধগম্য হচ্ছে না। আরেকটি বিষয় খুব বেশি দেখা যায়। আসামি গ্রেপ্তার হলেই ট্যাব, ল্যাপটপ ও কমপিউটার জব্দ করা হয়। আধুনিক সভ্যতায় ট্যাব, ল্যাপটপ ও কমপিউটার ব্যবহার খুব মামুলি ব্যাপার। এসব ট্যাব, ল্যাপটপ ও কমপিউটার জব্দ করে কি বোঝানো হয়। এসব ট্যাব, ল্যাপটপ ও কমপিউটার কি খুবই ক্ষতিকর বা ক্ষতির কারণ? আলোচ্য ঘটনায় প্রাসঙ্গিক না হলে কেন এসব করা হয়? বিজ্ঞান মনস্ক জাতি গড়তে যন্ত্রপাতি বা প্রযুক্তির ব্যবহার বাধ্যতামূলক। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী যদি বিনা কারণে এসব প্রযুক্তি নির্ভর যন্ত্রপাতি জব্দ করে, এতে প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রতি কোন নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হয় কিনা এটি ভেবে দেখা উচিত।
বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার আসামি ফারাবি একজন বিতর্কিত ব্লগার। তিনি ১০ এপ্রিল ২০১৯ বুধবার ঢাকার সাইবার ক্রাইম ট্রাইবুনাল থেকে খালাশ পেয়েছেন। তাকে গ্রেপ্তারের সময় এমন কিছু যন্ত্রপাতি জব্দ করা হয়েছিল। কি কারণে ওই যন্ত্রপাতি ফারাবির বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায়নি? প্রকৃত পক্ষে যন্ত্রপাতির ব্যবহারের ফলে অপরাধ ঘটলে এটি কাজে লাগত। কেবল জব্দ দেখানোর কারণে জব্দ করা হলে কোন কাজে আসে না। ভোলার সহকারী জজ জাবেদ ইমাম ২০১২ খ্রিস্টাব্দে ৩৪২ বোতল ফেনসিডিলসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ওই ঘটনায় তার চার বছর জেল হয়। কিন্তু জাবেদ ইমামকে গ্রেপ্তারের পর মিডিয়ার সামনে আসামির শরীরে স্টিকার লাগিয়ে হাজির করাকে বেআইনি বলে মত দেন আদালত। ১২ ডিসেম্বর ২০১২ প্রকাশিত সকল দৈনিক পত্রিকায় এদত সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। সাধারণত ফৌজদারি আইনে কেউ চূড়ান্ত দোষী সাব্যস্থ না পর্যন্ত অপরাধী বিবেচনা করার সুযোগ নাই। বরং বিচার চূড়ান্তভাবে নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ ধরে নিতে হবে। মামলা বিচারাধীন সময়ে অভিযুক্ত হিসাবে বিবেচিত হবে। কিন্তু সম্প্রতি অভিযুক্তদের মিডিয়ার সামনে এমনভাবে হাজির করা হয়, যেন তাদের নামে রায় দেওয়া হয়েছে। সরাসরি চোর, ডাকাত, খুনি স্টিকার লাগিয়ে আসামি হাজির করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। যা অস্বাভাবিক ও বেআইনি। বরং আইনে রায় দেওয়ার পর দোষী সাব্যস্থ হলে কারাগারে পাঠানো ছাড়া, কোন মিডিয়ায় উপস্থাপনের সুযোগ নেই। নিশ্চয়ই আমাদের ভেবে দেখা উচিত, পান সুপারি জব্দ করব কিনা।