সব

মায়ের সঙ্গে পাঁচ বছরের শিশুকে কোর্টহাজতে পাঠানোয় বাহদুরি নেই

AUTHOR: Primenews24bd Desk
POSTED: Wednesday 4th September 2019at 7:28 am
FILED AS: মতামত
56 Views

উজ্জ্বল রায়ঃ মায়ের সঙ্গে পাঁচ বছরের শিশু কোর্টহাজতে গেল। গরু চুরির সন্দেহভাজন আসামির কারণে ওই ঘটনার সূত্রপাত।

সন্দেহভাজন আসামিকে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে পুলিশ বাহিনি বাধার মুখে পড়েছে বলে অভিযোগে পরিবারের পাঁচজনকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় আদালতে চালান দেওয়া হয়েছে। আসামি ধরা, চালান প্রক্রিয়া ও কর্তৃপক্ষের বক্তব্য দেখে ব্যথিত, মর্মাহত ও ক্ষুদ্ধ হয়েছি। এটি কোন মানুষের জীবনে না ঘটুক এমন আশা করি। একজন সন্দেভাজন গরু চোরকে গ্রেপ্তার প্রক্রিয়ায় যে মনোযোগ এটি সমাজের সর্বত্র চালু হলে আমরা সুইডেনের মতো অচিরেই কারাগার বন্ধ করতে পারব।

বাংলাদেশে বর্তমানে ২০১৩ সালের শিশু আইন প্রচলিত রয়েছে। ওই আইন অধিকতর সংশোধন করা হয়েছে ২০১৮ সালে। এটি কার্যকর হয়েছে ২০১৮ সালের ১৪ নভেম্বর। শিশু আইন অল্প সময়ের ব্যবধানে সংশোধন করা হয়েছে আন্তর্জাতিক শিশু কোডের সঙ্গে সঙ্গতি স্থাপনের কারণে। মোটাদাগে সংশোধনে কিছু শব্দ বদল করা হয়েছে। আগের আইনে যেখানে শিশুকে ’আসামি’ বলা হতো, সেখানে নতুন আইনে ’আইনের সহিত সংঘাতে জড়িত শিশু’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। শিশুর প্রতি উদারতা দেখাতে যেখানে শব্দ প্রয়োগে আমরা সতর্ক সেখানে মায়ের সঙ্গে পাঁচ বছরের শিশুকে ৫৪ ধারার অভিযোগে জেলহাজতে রাখার নৈতিকতা ও আইন কতটা উদারতা দেখায়? থানার পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ যাদের নামে পুলিশের কাজে বাধার অভিযোগ রয়েছে, তাদের নামে নির্দিষ্ট মামলার পরিবর্তে ৫৪ ধারা কেন ব্যবহার করা হয়েছে। পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তার করে আদালতে চালান করতে পারলো, একটি নির্দিষ্ট মামলা দায়ের করতে পারল না? পুলিশ সাদা পোশাকে আসামিকে গ্রেপ্তার করতে চেয়েছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। যারা অভিযোগ করেছে তারা পুলিশের দৃষ্টিতে আইন লঙ্ঘনকারী বলে তাদের অভিযোগ আমলে নেওয়ার ক্ষেত্রে আইনগত কোন বাধা আছে। থানা পুলিশ কেন সাদা পোশাকে আসামি গ্রেপ্তার করতে চাইল এটি স্পষ্ট করতে সমস্যা কোথায়? শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতিবার (১৭ জানুয়ারি) রাতেই শিশুসহ চারজন জামিনে মুক্তি লাভ করে। যাদের জেলহাজতে পাঠানোর জন্য কোর্ট হাজতে পাঠানো হয়েছে, তারা পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন। এই অভিযোগ তদন্ত হতে বাধা কোথায়? পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে নারীশিশুসহ পরিবারের সকলকে গ্রেপ্তার করতে আইন যেভাবে কার্যকরা করা হয়েছে, একইভাবে পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ বিবেচনার দাবি রাখে না? জামিনে মুক্তি পাওয়া আসামির শরীরে কিভাবে ক্ষত তৈরি হলো, এটি কেন আইনে আওতায় আসবে না জানতে আগ্রহ জারি রাখলাম। গণমাধ্যমকর্মীরা কালিয়াকৈর থানায় গিয়ে দেখতে পায় থানায় মা সুফিয়া আক্তার, তার দুই মেয়ে হাসিনা আক্তার ও বকুল আক্তার উপ পরিদর্শকদের একটি কক্ষে বসে আছে।

সেখানে গিয়ে কি হয়েছিলো জানতে চাইলে, হাসিনা আক্তার বলেন, ‘আমার ভাইরে কিয়ের লাইগা ধরতে আইছেন ও কিরছে। এই কথা জিগানের পর দারগা জাফর তার পিঠে লাঠি দিয়ে বারি ও চর থাপর দেয়।, এসময়ে পাশের চেয়ারে বসে মা সুফিয়া ও ছোট মেয়ে বকুল কান্না করছিলো। আর বড় মেয়ে হাসিনার পাঁচ বছরের ছেলে থানার ভিতরে ও বাহির দিয়ে হাঁটাহাঁটি করছিলো।

গাজীপুরের পুলিশ সুপার যোগদানের পর গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে কোন পুলিশ কাউকে অহেতুক হয়রানি করলে তার পোশাক খুলে নিবেন বলে জানিয়েছিলেন। এতে আমরা খুবই আশাবাদী হয়েছিলাম। কিন্তু পাচ বছরের শিশুসহ মায়ের কারাবাসের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা কতটা আইন সঙ্গত আর কতটা হয়রানি এটি ঠিক করবে কে?

শিশু আইনের ১৯ ধারা ৪ উপধারার বিধান মতে, ’শিশু আদালত কর্তৃক শিশুর বিচার চলাকালীন, আইনজীবী, পুলিশ বা আদালতের কোন কর্মচারী আদালত কক্ষে তাহাদের পেশাগত বা দাপ্তরিক ইউনিফরম পরিধান করিতে পারিবেন না।’ আইনের এই বিধান করা হয়েছে যাতে আইনজীবী যে কোট, টাই ও গাউন পরিধান করে, পুলিশ যে পোশাক পরিধান করে বা আদালতের কর্মচারীরা যে নির্দিষ্ট পোশাক পড়ে তাতে শিশুর মনে ভীতির সঞ্চার হতে পারে। এতে একজন শিশুর ভবিষ্যত পুরোদমে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এসব বিধান যে শিশু আইন লঙ্ঘন করে আদালতে বিচারের মুখোমুখি হয়েছে তার জন্য। বিচারের মুখোমুখি শিশুকে হেফাজত করতে যেখানে আদালতকে সাধারণ স্থানের মতো বোঝানো হয়, তার বিপরীতে মায়ের অপরাধের কারণে বা অভিযোগের কারণে পাঁচ বছরের শিশুকে গারদে রাখার ভিত্তি কি? আইনে একজন শিশুসহ নারীকে পুলিশের জিম্মায় মুক্তি দিতে বাধা কোথায়? একজন শিক্ষার্থী যিনি চলতি বছর পরীক্ষায় অংশ নিবেন তাকে গারদে রাখার ৫৪ ধারার জোর কতটুকু? যাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তাদের এত দ্রুত আদালত জামিন দিয়ে কি ভুল করেছে?

’শিশুকে কারাগারে পাঠানোর বিষয়ে পুলিশ সুপার বলেন, মা চেয়েছেন বলেই শিশুকে তাঁর সঙ্গে রাখা হয়েছে। পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ থাকলে ৫৪ ধারায় কেন গ্রেপ্তার দেখানো – এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মামলার এজাহারে ঘটনার বর্ননা রয়েছে। বিচারকাজ শুরু হওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ উত্থাপন করা হবে (প্রথম আলো, ১৮ জানুয়ারি ২০১৮)। বিচার কাজ শুরু বলতে কি বোঝানো হয়েছে? আপাতত ৫৪ ধারা চলমান থাকবে? পরে আরেকটি মামলা দায়ের হবে? কিভাবে কেন পুলিশকে বাধা দেওয়া হয়েছে এই বয়ান বহাল থাকলে পাশ কাটানো আইনের প্রয়োজন কি?

শিশুশ্রম নিরসন নীতিমালা ২০১০, জাতীয় শিশু নীতি ২০১১, শিশুর প্রারম্ভিক যত্ন ও বিকাশের সমন্বেত নীতি ২০১৩ কাদের জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে? সাধারণ জনগণ এসব আইন ও নীতি জেনে চলবে, না পুলিশ ও বিচার বিভাগ এসব আইনের প্রয়োগ ঘটাবে? যদি প্রশ্ন করা হয়, একজন গরু চোরের পরিবারে প্রতি কেন এত কথা বলা হচ্ছে তাহলেও ফৌজদারি আইনের নীতি মনে করিয়ে দিয়ে তাকে আপাতত নির্দোষ দাবি করব।

শিশু আইন ও শিশুর শৈশব বিকাশে আমাদের অঙ্গীকার কেউ ভেঙে আরামে নিজেকে বিশুদ্ধ ভাববে এটি কামনা করি না। ভীতিকর পরিবেশে মানুষ বেড়ে ওঠে না। অন্তত মানব সভ্যতায় এটি প্রমাণ করে না। কারও পোশাক খুলে নেওয়া হবে কি না, এই নিয়ে ভাবনা নেই। তবে কোন শিশু যেন তার পিতামাতার অভ্যাস বা বাজে আচরণের কারণে পঙ্গুত্ব বরণ না করে এটি আশা করি। যারা একজন শিশুর জীবনে বিঘ্ন ঘটিয়েছে, তাদের জীবন সম্পর্কে কতটা সচেতন এটি ঠাহর করা অসম্ভব। তবে একজন শিশুর মধ্যেই আমরা আগামীর ভবিষ্যত দেখি।

 


সর্বশেষ খবর