মশার বিরুদ্ধে অস্ত্র হতে পারে চতুর্থ প্রজন্মের ওষুধ
আমারবাংলা ডেস্কঃ ডেঙ্গুসহ মশা বাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা জরুরি। এছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করা সব কয়টি সংস্থার প্রতিনিধি নিয়ে ‘সমন্বিত মশা নিয়ন্ত্রণ গবেষণা কেন্দ্র’ স্থাপন প্রয়োজন। রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা ছাড়াও মশা নিয়ন্ত্রণে জৈবিক, পরিবেশগত এবং যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় জোর দিতে হবে।
আজ শনিবার ‘মশা নিয়ন্ত্রণ ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এসব সুপারিশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় কালের কণ্ঠ ও ওরিয়ন ফার্মা লিমিটেডের যৌথ আয়োজনে গোলটেবিল বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছে।
কালের কণ্ঠ’র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামালের সঞ্চালনায় বৈঠকে প্রধান অতিথি হিসেবে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মো. তাজুল ইসলাম বলেন, এপ্রিল মাস থেকে মশা ও জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণের জন্য সভা হয়েছিলো। সংশ্লিষ্ট সব কয়টি সংস্থার চেষ্টার পরও মশা দেশের মানুষের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় মশক নিয়ন্ত্রণে অনেকটা সফল হয়েছি। এই কাজ আরো বেগবান করা হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আতিকুল ইসলাম জানান, বিক্ষিপ্তভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ হয় এদেশে। একটি সিন্ডিকেটকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন মশার ওষুধ আমদানি বন্ধ রাখা হয়। গুটিকয়েক কম্পানি শুধুমাত্র মশার ওষুধ আনতে পারতো। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিভাগ এই কাজ করেছে। ওই বিভাগের অসাধু এসব কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় আনা জরুরি।
তিনি বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে বছরব্যাপী কর্মসূচি বাস্তায়নের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ওষুধের সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া হয়েছে। মশা নিয়ন্ত্রণে চতুর্থ প্রজন্মের ওষুধ ব্যবহারের চিন্তা করা হচ্ছে।
স্বাগত বক্তব্যে কালের কণ্ঠ ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোস্তফা কামাল বলেন, ডেঙ্গুর মতো একটি বড় ইস্যুতে ওরিয়ন গ্রুপ আমাদের সঙ্গে থাকায় ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সারাবছর সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে কালের কণ্ঠে ডেঙ্গু নিয়ে তথ্য বহুল সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে। তবে ডেঙ্গুতে যত সংখ্যক রোগী আক্রান্ত হয়েছে সে অনুযায়ী প্রস্তুতি ছিলো না। আতঙ্কিত না হয়ে সচেতনতা বাড়ানোর বিষয়ে নীতি-নির্ধারকরা বলেছেন। এটা স্বল্প মেয়াদী কোনো বিষয় নয়, ডেঙ্গু সারা বছরই থাকে। তাই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে মশক নিধন কাজ অব্যাহত রাখতে হবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. হাবিবুর রহমান খান বলেন, প্রতি বছর সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। কিন্তু এ বছর আগস্টে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেওয়ার কারণে আমাদের হিমশিক খেতে হয়েছে। তবে সরকারি বিভিন্ন দপ্তর ও সিটি করপোরেশনের কোন কমতি ছিলোনা ডেঙ্গুর প্রকোপ মোকাবেলায়।
কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে আমার পক্ষে কোন ধরণের ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়নি। তবে এই বিষয়টা নিয়ে একটা উদ্বেগ ছিলো। স্বাস্থ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে দেখেছি তাঁদের মধ্যেও উদ্বেগ ছিলো। আর গণমাধ্যমের কারণে বিষয়টি সবাই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, মশা সব সময় ছিলো। আতঙ্কিত না হয়ে এর সঙ্গে সংগ্রাম করেই আমাদের চলতে হবে। চলতি বছরে এতো রোগী আক্রান্ত হবে তা ধারণা করা যায়নি। তবে চিকিত্সকসহ সবার আন্তরিকতা থাকায় সংকট অনেকটা কেটে গেছে। কাউকে দোষারূপ না করে এডিস নিয়ন্ত্রণে জোর দিতে হবে।
ওরিয়ন ফার্মার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আরিফ হোসেন বলেন, আমরা মেডিসিন সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করি। তবে এই গোলটেবিল বৈঠকের মতো জনসচেতনতামুলক ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কাজ করতে পেরে আমরা গর্বিত।
গোলটেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও কীটতত্ত্ববিদ আধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জনস্বাস্থ্য ও রোগতত্ত্ব পরামর্শক ড. মুশতাক হোসেন, কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর এ চৌধুরী ও অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার, ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মমিনুর রহমান মামুন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. শরীফ আহমেদ, পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক রুবিনা ফেরদৌসী, শহীদ সোহরাওয়াদী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. শাকিল আহম্মেদ, বাংলাদেশ ডায়গনস্টিক রিয়েজেন্ট অ্যান্ড ইক্যুইপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি একেএম কামরুজ্জামান, সুপ্রীম কোর্টের ডেপুটি এটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার কাজী মাঈনুল হাসান, বিআরবি হাসপাতালের সিইও মেজর ডা. একেএম মাহবুবুল হক (অব.), স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ডা. আয়েশা আক্তার, বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি তৌফিক মারুফ, ডেঙ্গুতে সন্তান হারানো বাবা মোহাম্মদ আফাজ্জল হোসেন প্রমুখ।
বৈঠকে বক্তারা বলেন, এডিস মশার প্রকোপ কিছুটা কমে আসলেও দেশের প্রায় সব কয়টি জেলায় তা ছড়িয়েছে। কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণে সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিভাগ এবং পরিবেশ অধিদপ্তর কাজ করে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানে কীটতত্ত্ববিদের অভাব রয়েছে। তাই এসব সংস্থার প্রতিনিধির সমন্বয়ে ‘মশক নিয়ন্ত্রণ গবেষণা কেন্দ্র’ স্থাপন জরুরি। কেন্দ্রটি স্থাপনে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগী হতে হবে।
বক্তারা আরো বলেন, সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং সরকারি বিভিন্ন সংস্থা মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করলেও ফলপ্রসূ তেমন কোনো গবেষণা নেই। প্রতি বছর এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সেপ্টেম্বরে তোড়জোর শুরু হয়। কিন্তু এবছর আগস্টেই ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। ফলে সরকারি বিভিন্ন হাসপাতাল বিপুল সংখ্যক রোগীর চাপ সামলাতে প্রস্তুত ছিলো না। মূলত গবেষণার না থাকার কারণেই এটি হয়েছে। তাই মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি বছর ব্যাপী চালু রাখা জরুরি। মশক ব্যবস্থাপনায় নগরবাসীকেও সম্পৃক্ত করতে হবে।
সূত্র কালের কন্ঠ