সব

মিয়ানমার সব রোহিঙ্গা ফেরত নিতে হবে

AUTHOR: Primenews24bd Desk
POSTED: Friday 13th January 2017at 3:14 pm
39 Views

48স্টাফ রিপোর্টারঃ অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ থেকে সব রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে হবে। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি’র সফররত বিশেষ দূত ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী চাও টিনের কাছে এই কড়া বার্তা দিয়েছে বাংলাদেশ।

তবে মিয়ানমার চায় শুধু সম্প্রতি আসা রোহিঙ্গাদের নিয়ে আলোচনা। এ ছাড়াও, রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের লক্ষ্যে মিয়ানমারের কাছে পাঁচ দফার প্যাকেজ প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। এতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে কর্মকৌশল প্রণয়ন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

এ ছাড়া তাদের নাগরিকত্ব বা স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার বিষয়টি যাচাইয়ের জন্য যথাযথ কমিটি গঠন এবং নিরাপত্তা সহযোগিতা বৃদ্ধিতে দুটি চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি, বাংলাদেশ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চেয়েছে। চাও টিন মিয়ানমার ফিরে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছে এসব প্রস্তাব তুলে ধরবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, বর্তমানে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছেন। তাদের মধ্যে গত দুই মাসে পালিয়ে এসেছেন ৬৫ হাজার। এর বাইরে অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা আছেন তিন লাখ। এ ছাড়া শরণার্থী মর্যাদা নিয়ে কতুপালং শিবিরে আছেন ৩৩ হাজার রোহিঙ্গা । রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা বন্ধ করে অবিলম্বে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে জোর দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ।

বৃহস্পতিবার এ উপলক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার দফতরে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, মিয়ানমারের বিশেষ দূতের এ সফর জটিল বিষয়ে আলোচনার পথ সুগম করবে। এর ফলে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন। এতে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হক, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (দ্বিপক্ষীয়) মাহবুবুজ্জামান ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অনুবিভাগের মহাপরিচালক মঞ্জুরুল করিম খান চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। এক প্রশ্নের জবাবে মাহমুদ আলী বলেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমারের নাগরিকদের সু চি রাখাইন মুসলিম হিসেবে সম্বোধন করেন। রাখাইন মুসলিম হিসেবে অভিহিত করলেই মিয়ানমার স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।

বাংলাদেশ সরকারও তাদের রোহিঙ্গা নয়; রাখাইন মুসলিম নামে ডাকতে শুরু করেছে। প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গা শব্দের মানে হল আদি বাসিন্দা। এই নামের মাধ্যমে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠার ভয় আছে এমন আশংকা থেকেই রোহিঙ্গা শব্দটি নিষিদ্ধ করেছে মিয়ানমার। রাখাইন রাজ্যে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ। যাতে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী মিয়ানমার নাগরিকরা পূর্ণ নিরাপত্তা ও জীবিকার নিশ্চয়তাসহ দ্রুত নিজ আবাসে ফিরে যেতে পারেন।

সু চি’র বিশেষ দূতের সঙ্গে আলোচনায় নিরাপত্তা সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আলোচনাধীন দু’টি সমঝোতা স্মারকের বিষয়ে একমত হয়েছে দুই দেশ। স্মারক দুটি হচ্ছে, নিরাপত্তা সংলাপ ও সহযোগিতা এবং বর্ডার লিয়াজোঁ অফিস। এ ছাড়া উচ্চপর্যায়ের সফর বিনিময়ের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে দুই পক্ষ একমত হয়।

মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সুচির বিশেষ দূত দেশটির পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী চাও টিন বর্তমানে বাংলাদেশ সফর করছেন। তিনি বুধবার পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হক এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে বৈঠক করেন। মিয়ানমারের বিশেষ দূত সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী বলেছেন, অত্যন্ত সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী বৈঠককালে মিয়ানমারের বিশেষ দূত সে দেশের নতুন সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন ও সহযোগিতা বৃদ্ধির আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন বলে জানান। তিনি আলোচনার মাধ্যমে মতপার্থক্য দূর ও সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের আগ্রহের কথা তুলে ধরেন। বিশেষ দূত ৯ অক্টোবরের সীমান্ত ফাঁড়িতে সন্ত্রাসী হামলার

পর বাংলাদেশের ভূমিকা ও সহযোগিতার প্রশংসা করেন। মিয়ানমারের গণমাধ্যমে ৯ অক্টোবর সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততার ইঙ্গিতপূর্ণ সংবাদ প্রকাশের প্রসঙ্গ টেনে বিশেষ দূত বলেন, মিয়ানমার সরকার কখনো বাংলাদেশকে দোষারোপ করেনি। তিনি সীমান্ত ব্যবস্থাপনাসহ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে দু’দেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করেন। মিয়ানমারের নতুন সরকার রাখাইন রাজ্যে মুসলমান জনগোষ্ঠীর সমস্যা সমাধানে কফি আনান কমিশন গঠনসহ অনেক উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানান।

তাছাড়া জটিল বিষয়গুলোতে ইতিবাচক ও আন্তরিক আলোচনার আহ্বান জানানো হয়। ৯ অক্টোবরের ঘটনার পর থেকে বিপুলসংখ্যক মিয়ানমার নাগরিকের বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ। বিপুলসংখ্যক মিয়ানমার নাগরিকের দীর্ঘ অবৈধ অবস্থানের কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চট্টগ্রাম এলাকা বিশেষত কক্সবাজার অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে বিশেষ দূতকে অবহিত করা হয়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী বলেন, রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলমান জনগোষ্ঠী গণহারে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান ও মূল সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে যথাযথ উদ্যোগ নেয়ার জন্য মিয়ানমারকে অনুরোধ জানানো হয়। আলোচনাকালে বাংলাদেশ মিয়ানমারের নিবন্ধিত শরণার্থী, অনিবন্ধিত মিয়ানমার নাগরিক এবং নবাগতদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের দাবি জানায় এবং এ লক্ষ্যে একটি কর্মকৌশল নির্ধারণের প্রস্তাব করে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, মিয়ানমার প্রাথমিকভাবে গত ২ মাসে রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারীদের প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে তাদের নাগরিকত্ব বা স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার দাবি যাচাইয়ের প্রক্রিয়া শুরুর আগ্রহ প্রকাশ করে। বাংলাদেশ মিয়ানমারের নিবন্ধিত শরণার্থী, অনিবন্ধিত এবং নতুন আগত মিয়ানমার নাগরিকদের প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে একই সঙ্গে উদ্যোগ নেয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরে।

প্রত্যাবাসনকে কার্যকর এবং টেকসই করার জন্য রাখাইন রাজ্যে নিরাপদ ও টেকসই জীবিকার সুযোগ নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। যাতে প্রত্যাবাসনকারী নিজ ভূমিতে নিরাপত্তা ও সম্মানসহ স্বাভাবিক জীবিকা অর্জনের সুযোগ পান। তাছাড়া রাখাইন মুসলিমদের প্রান্তিকীকরণ রোধ ও তাদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত জরুরি। অন্যথায় প্রত্যাবাসনকারী সংখ্যালঘুরা পুনরায় ফিরে আসতে পারেন বলে বাংলাদেশ মত প্রকাশ করে। এ বিষয়ে সমন্বিত ও সামগ্রিক কর্মপন্থা নির্ধারণের প্রস্তাব করে বাংলাদেশ। দু’পক্ষই এ বিষয়ে অনতিবিলম্বে আলোচনা করতে সম্মত হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বুধবার সন্ধ্যায় সাক্ষাৎ করেন মিয়ানমারের বিশেষ দূত। এ সময় তিনি রাখাইন রাজ্যের ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সশস্ত্র চরমপন্থা বিকাশের সম্ভাবনা উল্লেখ করে এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সহযোগিতা চান। এ সময় সন্ত্রাস ও উগ্র জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির বিষয় তার সামনে তুলে ধরা হয়। প্রধানমন্ত্রী বিশেষ দূতকে অবহিত করেন, বাংলাদেশ কোনো প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে নিজস্ব ভূমি ব্যবহার করতে দেয় না। প্রধানমন্ত্রী ধর্মীয় ও জাতিগত উগ্রবাদ এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মিয়ানমারকে পূর্ণ সহযোগিতার নিশ্চয়তা দেন।

বিশেষ দূত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে প্রধানমন্ত্রী দ্রুত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার ওপর জোর দেন। তিনি আরও বলেন যে, মিয়ানমারের জনগোষ্ঠী প্রত্যাবাসনে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হলে তা দু’দেশের মধ্যে বোঝাপড়া ও দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচিকে সব প্রকার সহায়তার আশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করেন।

প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচিকে বাংলাদেশ সফরের জন্যে পুনরায় আমন্ত্রণ জানান। গত বছরের ৯ অক্টোবর সীমান্ত চৌকিতে সন্ত্রাসী হামলায় মিয়ানমারের নয়জন ‘বর্ডার গার্ড পুলিশ’ (বিজিপি) সদস্য নিহত হওয়ার জের ধরে দেশটির সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে অভিযান শুরু করে।

এ অভিযানে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নির্বিচারে রোহিঙ্গাদের হত্যা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। তারপর থেকে রোহিঙ্গারা প্রাণভয়ে দলে দলে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে থাকেন। এ নিয়ে মিয়ানমার সরকার আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের মুখে পড়েছে।

তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে অং সান সুচি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ইয়াঙ্গুনে ডেকেছিলেন। ওই সময়ে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রতনো মারসুদিকে সুচি জানান যে, তিনি সংকট নিয়ে আলোচনার লক্ষ্যে একজন বিশেষ দূতকে ঢাকায় পাঠাতে চান। তখন ওই প্রস্তাব নিয়ে মারসুদি ঢাকায় আসেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর কাছে প্রস্তাবটি তুলে ধরেন।

সুচির এ প্রস্তাবকে গ্রহণ করে বাংলাদেশ। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ দূতের এবারের ঢাকা সফর অনুষ্ঠিত হচ্ছে। রতনো মারসুদি জাকার্তা ফিরে গিয়ে মন্তব্য করেছেন যে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বর্তমান রোহিঙ্গা সংকটের উদ্ভব হয়েছে। ফলে এ সংকটের সমাধান মিয়ানমারের ভেতরেই হওয়া উচিত। আসিয়ানের অন্যতম বড় দেশ মালয়েশিয়াও রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-পীড়নে মিয়ানমারের কঠোর সমালোচনা করছে।

মালয়েশিয়া ১৯ জানুয়ারি রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক আহ্বান করেছে। বৈঠকে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জাতিসংঘ আগে থেকেই রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। নতুন করে রোহিঙ্গা সংকট তীব্র আকার ধারণ করায় জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের দফতর পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে প্রতিনিধি পাঠানো শুরু করেছে।

আগামী কিছু দিনের মধ্যে আরও অনেকে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার জেনেভা দফতর থেকে ঢাকায় আসবেন বলে জানা গেছে। বর্তমান জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রধান থাকাকালে ২০০৮ সালে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। ওই সময়ে তিনি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেন।

 

 

 


সর্বশেষ খবর