রিজার্ভ চুরির সাড়ে ৬ কোটি ডলার ফেরত অনিশ্চিত
স্টাফ রিপোর্টারঃ রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংক কর্পোরেশনের (আরসিবিসি) আপত্তির মুখে রিজার্ভ চুরির সাড়ে ৬ কোটি ডলার ফেরত পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। চুরির ১ কোটি ৫৪ লাখ ডলারের এখন পর্যন্ত হদিস পাওয়া যায়নি। বাকি অর্থের ব্যাপারে ফিলিপাইন সরকার তিনটি মামলা করেছে। আরও দুটি মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
মামলাগুলোই টাকা ফেরত পাওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি করছে। এ সময়ক্ষেপণই অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে এ পর্যন্ত নেয়া পদক্ষেপগুলোর দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। এসব কারণে খোদ অর্থ প্রতিমন্ত্রীও টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা প্রকাশ করেছেন। তার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন আর্থিক খাতের সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি এক বিবৃতিতে আরসিবিসি জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির অর্থ তারা ফেরত দেবে না। কারণ দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবহেলার কারণেই রিজার্ভের অর্থ চুরি হয়েছে। সংস্থাটির এ ধরনের ঘোষণা টাকা ফেরত পাওয়ার বিষয়টিকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। এর পর পরই অর্থ উদ্ধারে ব্যবস্থা নিতে ফিলিপাইন সফর করেছে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল। ফিলিপাইন সরকার রিজার্ভ চুরির অর্থ আদায়ে সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে বলে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলকে আশ্বাস দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থ প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান সোমবার
বলেন, ফিলিপাইন থেকে রিজার্ভ চুরির অর্থ ফেরত আনতে সরকার সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ঘটনার দায় হিসেবে আরসিবিসি ব্যাংকের বিরুদ্ধে জরিমানা আরোপ করেছে ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে প্রমাণিত হয়, চুরির ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে আরসিবিসির। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এ অর্থ ফেরত পাওয়া অনিশ্চিত।
জানা গেছে, রিজার্ভের অর্থ উদ্ধারে সর্বশেষ আন্তর্জাতিক আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটসহ (এগমন গ্রুপ) ৪টি সংস্থার কাছে সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। অন্য সংস্থাগুলো হচ্ছে- বিশ্বব্যাংক, অর্থ পাচারে মান নির্ধারণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এশীয় প্যাসিফিক গ্রুপ (এপিজি) ও ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স (এফএটিএফ)। বাংলাদেশ ব্যাংক এসব সংস্থার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে চুরি করে নেয়া হয়। এর মধ্যে ৬ কোটি ৫৬ লাখ ডলারের সন্ধান পাওয়া গেছে। আর ১ কোটি ৫৪ লাখ ডলারের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
সন্ধান পাওয়া রিজার্ভের অর্থের মধ্যে ২ কোটি ৮০ লাখ ডলার আছে সোনেয়ার রিসোর্ট ও ক্যাসিনো ম্যানিলার ব্যাংক হিসাবে। ১ কোটি ৭০ লাখ ডলার আছে ফিলিপাইনের রেমিটেন্স কোম্পানি ফিলরেমের হিসাবে। ৬০ লাখ ডলার এখনও রয়েছে কিম অংয়ের কাছে। আর দেশে ফেরত এসেছে ১ কোটি ৪৫ লাখ ডলার।
জানা গেছে, অর্থ ফেরত আনতে সরকার গঠিত টাস্কফোর্সের বৈঠক সম্প্রতি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ফিলিপাইনের এন্টিমানিলন্ডারিং কাউন্সিল (এএমএলসি) এবং বিচার বিভাগের কাছে রিজার্ভ উদ্ধারের আইনগত প্রক্রিয়ার অগ্রগতি জানার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নির্দেশ দেয়া হয়। টাস্কফোর্স বৈঠকের কার্যবিবরণীতে উল্লেখ্য করা হয়, গত বছর ১৬ আগস্ট নিউইয়র্কে রিজার্ভ চুরির অর্থ উদ্ধারের বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক এবং সুইফটের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়। সেখানে সংস্থাগুলোর কর্তৃপক্ষ চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধারে একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে।
পাশাপাশি এ সংক্রান্ত একটি যৌথ ঘোষণাপত্র জারি করা হয়। ওই ঘোষণাপত্রের সূত্র ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে সহায়তা চেয়েছে এবং যোগাযোগ রাখছে। বৈঠকে টাস্কফোর্সের সভাপতি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. ইউনুসুর রহমান বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির অর্থ ফেরত আনতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো নিয়ে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন।
সূত্রমতে, চুরি হওয়া রিজার্ভের ২ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার সোনেয়ার ক্যাসিনোর কাছে রয়েছে। এ ব্যাপারে ফিলিপাইনের উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ক্যাসিনোর ব্যাংক হিসাবটি ফ্রিজ (জব্দ) করা হয়। পাশাপাশি ফিলিপাইনের সুপ্রিমকোর্টের মাধ্যমে ক্যাসিনোর ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ আদেশের পক্ষে অস্থায়ীভাবে আরও একটি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কারণ উচ্চ আদালতের আদেশ যে কোনো সময় তুলে নেয়া হলেও সুপ্রিমকোর্টের এ আদেশে ক্যাসিনো কর্তৃপক্ষ হিসাব থেকে অর্থ উত্তোলন করতে পারবে না।
এদিকে এ চুরির সঙ্গে দেশী এবং বিদেশী চক্র জড়িত থাকার বিষয়টি সরকার নিশ্চিত হয়েছে। ফলে দেশের বাইরের জড়িত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেয়ার কথা ভাবছে সরকার। তবে নিয়ম অনুযায়ী বিদেশী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করতে একটি নির্দিষ্ট টাইম ফ্রেম থাকে।
এর মধ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বিদেশীদের বিরুদ্ধে মামলা বা আইনি পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের টাইম ফ্রেমের প্রয়োজন আছে কিনা, তা জানার নির্দেশ দেয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটকে (বিএফআইইউ)। এক্ষেত্রে দেশের বিজ্ঞ আইনজীবীদের মতামত সংগ্রহের কথা বলা হয়।
টাস্কফোর্স বৈঠকে বিএফআইইউ’র মহাব্যবস্থাপক দেবপ্রসাদ দেবনাথ বলেন, রিজার্ভ চুরির ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে আরসিবিসির বিরুদ্ধে এরই মধ্যে ২ কোটি ১০ লাখ ডলার জরিমানা আরোপ করেছে ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি আরসিবিসির ৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে ফিলিপাইনের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। এ পদক্ষেপগুলোর মাধ্যমে আরসিবিসি ব্যাংক রিজার্ভ চুরির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
সূত্রমতে, ফিলিপিনো-চাইনিজ ব্যবসায়ী কিম অং কর্তৃক ৪৬ লাখ মার্কিন ডলার এবং প্রায় ৪৯ কোটি পেসো বাংলাদেশকে ফেরত দিতে আদালতে একটি যৌথ প্রস্তাব দাখিল করেছে। এ প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেছে কিম অং এবং এএমএলসি। এ দাখিলের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ১ কোটি ৪৫ লাখ মার্কিন ডলার ফেরত পেয়েছে।