অন্তরে নারী,শরীরে পুরুষ,এরাও মানুষ
সালেহ্ রনকঃ প্রকৃতির বিচার আমরা প্রায়শই দেখি, আবার প্রকৃতি কখনো কখনো অবিচার করে যা খুবই নির্মম,বেদনাদায়ক। প্রকৃতি যার বা যাদের উপর অবিচার করে তাদের অসহায়ত্বের আর শেষ থাকেনা,নানাবিধ বঞ্চনা আর নিগ্রহের শিকার হতে হয়। প্রকৃতির খেয়ালিপনায়, অবিচারে যার বা যাদের জন্ম হয়,তাদের অবিচারের মাঝে বেড়ে ওঠা, বেঁচে থাকা, টিকে থাকা যেন নিয়তি নির্ধারিত! তাদের পাশে কেউ থাকেনা, না পরিবার, না সমাজ, না দেশ…কেউ না।
ব্যস্ত নগরীগুলোতে যারা বসবাস করে তাদের কম বেশি হিজড়াদের সঙ্গে দেখা হয়,তাদের সামনে পড়তে হয়,চাইলেও অনেক সময় এড়িয়ে যেতে পারে না। অনেকেরই হিজড়াদের নিয়ে অভিযোগের শেষ নাই। হিজড়াদের হঠাৎ উপস্হিতিতে কেউ কেউ আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ে, কেউ বিরক্ত হয়, কেউ কেউ ঘৃণায় নাক সিটকায়, কেউ কেউ অমানবিক হয়ে উঠে গায়ে হাত তুলে, রক্তাক্ত করে, কেউ মানবিক হয়, কেউ আবার ‘ম্যানুফ্যাকচারিং ডিফেক্ট’ বলে ডাকে, হাসিতে গড়াগড়ি খায়।
সাধারণত ক্রোমোজোম বা হরমোনে ত্রুটি অথবা মানসিক কারণে কারও লিঙ্গ পরিচয় নির্ধারণে যখন জটিলতা দেখা দেয় অথবা দৈহিক লিঙ্গ পরিচয়ের সঙ্গে আচরণগত মিল যখন খুঁজে না পাওয়া যায়,তখন তাদেরকে চিহ্নিত করা হয় হিজড়া হিসেবে। বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে প্রকৃতির শাস্তি প্রাপ্ত এই জনগোষ্ঠিকে তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দিয়েছে।
অবিচারের সিঁড়ি ভেঙ্গেই জীবন পার করছে হিজড়া জনগোষ্ঠি।হিজড়াদের মতো বার্থডিফেক্টেড মানুষগুলোর প্রতি প্রথম অবিচার প্রকৃতির। দ্বিতীয় অবিচার পারিবারিক। তৃতীয় অবিচার সামাজিক। চতুর্থ এবং শেষ অবিচার রাষ্ট্রীয়। প্রকৃতি বা স্রষ্টার অনায্য আচরনের শিকার এই সেক্সুয়াল জন্মত্রুটি নিয়ে জন্মানো বাচ্চাগুলো একটা সময়ে নিজের জন্মদাতা পিতা-মাতা কাছেই অপাঙ্ক্তেয় হয়ে ওঠে। যে প্রেমের মাঝে ওদের জন্ম, যে ভালোবাসার ছোঁয়ায় ওদের দুনিয়াতে আগমন, সেই প্রেম, ভালোবাসা ওদের কপালে দীর্ঘস্হায়ী হয়না।মায়ের মমতা,বাবার স্নেহ যেন কর্পূরের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, প্রিয় পরিবারে অপ্রিয় হয়ে, পরিজন পরিবার ছাড়তে বাধ্য হয় চিরদিনের জন্য,হয় সমাজচ্যুত। অচিরেই মুখোমুখি হয় চরম ও নির্মম জীবন ব্যবস্হার। আর নারী পুরুষ চিহ্নিত সমাজের অধিকাংশ মানুষ এদের মানুষই মনে করেনা, অচ্ছুত মনে করে দুরে ঠেলে দেয়,সমাজের মাঝে থেকেও এরা অস্পৃশ্য হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ হচ্ছে হিজড়া জনগোষ্ঠি। আবহমান কাল থেকে এ জনগোষ্ঠী অবহেলিত ও অনগ্রসর গোষ্ঠী হিসেবে সমাজ, রাষ্ট্রে টিকে আছে। সম্ভাবনা থাকা স্বত্তেও জনশক্তির মূলধারায় সম্পৃক্ত করা হয়নি। এর মূল কারণ দেশের মানুষের কুসংস্কার,ধর্মান্ধতা,নেগেটিভ দৃষ্টিভংগী ইত্যাদি। এদের জীবনে কখনোই কোন প্রথম পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা জোটেনি। অবহেলা, অপমানকে সঙ্গী করে এরা বেঁচে থাকার তাগিদে দিনকে দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে, জড়িয়ে পড়ছে নানাবিধ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। যখন কারো উপার্জনের উপায় থাকেনা, বেঁচে থাকার জন্য কাজ থাকেনা, তখনই সে উপায়ন্ত না পেয়ে অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়ে। হিজরা জনগোষ্ঠির বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ঢাকা শহরের বিভিন্ন সিগন্যালে প্রতিদিনই দেখা যায় দলবেধে হিজরারা ঘিরে ধরেছে কোন রিক্সা কিংবা গাড়িকে। বিভিন্ন অংকের টাকা দাবি করে এরা, বিভিন্ন কৌশলে টাকা আদায় করে ছাড়ে। আগে এদেরকে বর্তমানের মতো এতোটা আগ্রাসী রূপে দেখা যায়নি। জীবন যাত্রার ব্যয়ভার বাড়ার সাথে সাথে এদের জীবন যেমন আরো কঠিন হয়ে উঠেছে তেমনি এরাও টাকা আদায়ের ক্ষেত্রে কখনো কখনো ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। কখনো কখনো এমনও দেখেছি নরম গরম বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেও যখন টাকা আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছে কিংবা প্রত্যাশিত অংকের টাকা পায়নি তখন বিশ্রী ভাষায় গালাগালি করতে। আশেপাশের পথচারী, যাত্রীরা তখন ভীষণ বিড়ম্বনার মাঝে পড়ে যায়,পরিবার সাথে থাকলে কেউ কেউ লজ্জায় মুখ লুকায়। আবার এর উল্টোটাও দেখেছি, টাকা চাইতে গিয়ে কেউ কেউ রক্তাক্ত হয়েছে, কেউবামার খেয়ে কান্নাভেজা গালাগালি করতে করতে চলে গেছে। আর এর সবই হচ্ছে হিজড়াদের প্রতি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবহেলা ও অন্যায়ের কারনে।
হিজড়া জনগোষ্ঠির দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ প্রায় নাগরিক জীবন। কখনো কখনো এরা দলবেধে বাসা বাড়িতে গিয়েও কখনো কখনো চলন্ত বাসে উঠেও চাঁদা দাবি করছে। আর এর অন্যতম প্রধান কারন এই অসহায় ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠির ভিতর সংঘবদ্ধ অপরাধীরা সুযোগ বুঝে ঢুকে পড়েছে। বড় বড় নগরীগুলোতে সাধারণ হিজরারেদের চেয়ে অহিজাড়াদের সংখ্যা নেহাত কম নয়, যারা হিজড়া সেজে নানা রকম অপরাধ,সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এদের উপর কোন প্রকার দেখবাল না থাকার কারনে দিনকে দিন এরা বেপরোয়া কার্যকলাপে লিপ্ত হচ্ছে। সাধারণ হিজড়ারা সংঘবদ্ধ অপরাধীদের ছত্রছায়ায় মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে নানা অসামজিক কর্মকান্ডের যোগান দিচ্ছে।
সময় অনেক গড়িয়ে গেছে। সমাজ তথা রাষ্ট্রের হিজড়া জনগোষ্ঠির প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া ছাড়া এই পরিস্হিতি থেকে উত্তরণের উপায় নেই। হিজড়া জনগোষ্ঠির প্রতি আমাদের দৃষ্টিভংগী বদলাতে হবে, হতে হবে ইতিবাচকভাবে। রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে এরাও অন্যান্য জন্ম বিকলাঙ্গ বাচ্চাদের মতই।তবে হিজড়ারা অনান্যদের চেয়ে বরং অনেক দিক দিয়ে অনেক বেশি এগিয়ে। এই জনগোষ্ঠি সেরকম বিকলাঙ্গ নয় যে অনান্যদের মতো কাজকর্মে বা পড়ালেখায় অক্ষম।এরা অক্ষম শুধুমাত্র প্রজননে। তাই এদেরকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণ করতে হবে, এদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও কর্মসংস্হানের ব্যবস্হা করতে হবে। রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদী যথাযথ পরিকল্পনাই পারে এদেরকে অমর্যাদার ও অন্ধকার জীবন থেকে ফিরিয়ে এনে স্বাভাবিক ও সুন্দর জীবনের বিধান করতে। আর এরা স্বাভাবিক ও নিয়মাতান্ত্রিক জীবনে ফিরে এলে, পরগাছার মতো এদের আশ্রয় করে বেড়ে ওঠা অপরাধী, সন্ত্রাসীরা এমনিতেই পালিয়ে যাবে,ঝরে যাবে।
বাংলাদেশে বেসরকারি হিসেবে প্রায় ১৫ হাজার হিজড়া জনগোষ্ঠী রয়েছে।সমাজ সেবা অধিদপ্তরের জরিপের হিসাবমতে এই সংখ্যা আরো কম,প্রায় ১০ হাজার। এই স্বল্প সংখ্যক জনগোষ্ঠির জীবন মানের উন্নয়ন কোন বৃহৎ কর্মযজ্ঞ নয়। গত বছর শুনেছিলাম এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠিকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করার জন্য রাষ্ট্র বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে কিন্তু দীর্ঘসময় অতিবাহিত হলেও দৃশ্যমান কোন কার্যক্রম ও পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। সমাজে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার এ জনগোষ্ঠীর পারিবারিক, আর্থসামাজিক, শিক্ষা ব্যবস্থা, বাসস্থান, স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ সর্বোপরি তাদেরকে সমাজের মূল স্রোতধারায় এনে দেশের সার্বিক উন্নয়নে তাদেরকে সম্পৃক্তকরণের লক্ষ্যে সরকারের নানাবিধ কার্যকরী কর্মসূচি গ্রহণ ছাড় কোন গত্যন্তর নেই। নইলে নিজ মাতৃভূমিতে পরবাসী এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠি ধীরে ধীরে অপরাধ জগতের অতলে তলিয়ে যাবে এবং রাষ্ট্রের জন্য চরম অশনিসংকেত হয়ে রাষ্ট্রের বুকে চেপে বসবে। তখন রাস্ট্র নামক যন্ত্রের আফসোস করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।
বাঙালির মজ্জাগত বৈশিষ্ট্য হলো ঘরকে বাদ দিয়ে পরকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠা, নাচানাচি করা। পরকে নিয়ে আদিখ্যেতা দেখানোতে এদের জুড়ি মেলা ভার। যে রাষ্ট্র ৫ লাখের অধিক ভিনদেশী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির দায়িত্ব নিতে পারে সে রাষ্ট্রের পক্ষে নিজ দেশের মাত্র ১০ হাজার হিজড়া নাগরিকের জীবন মানের দায়িত্ব নেয়া কোন ব্যাপারই না। রাষ্ট্র একটু মানবিক হলে, একটু দায়িত্বশীল হলেই সম্ভব, খুউব সম্ভব।।
সমাজকর্মী, শিক্ষক ও অপরাজিতা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান
১১ এপ্রিল ২০১৮ ভোলা