সব

দূতাবাস চালু করল ইরান ও ব্রিটেন; আমেরিকার খবর কী?

AUTHOR: Primenews24bd Desk
POSTED: Wednesday 25th November 2015at 2:22 pm
FILED AS: মতামত
26 Views

10

 

সিরাজুল ইসলাম, তেহরান থেকে ঃ ইরান ও ছয় জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে পরমাণু ইস্যুতে চূড়ান্ত চুক্তি সইয়ের পর তেহরানে দূতাবাস চালু করেছে ব্রিটেন। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ড তেহরানে দু’দিনের গুরুত্বপূর্ণ সফরে এসে দূতাবাস চালু করেন। একইদিন ইরানও ব্রিটেনে দূতাবাস চালু করেছে।

২০১১ সালে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর ইরানের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এতে দু’দেশের সম্পর্কে অবনতি ঘটে এবং তেহরানের ব্রিটিশ দূতাবাসে একদল তরুণ হামলা করে। এরপর তেহরানে দূতাবাস বন্ধ করে দেয় ব্রিটিশ সরকার এবং একই ব্যবস্থা নেয় ইরান।

চার বছর পর আবার দু’দেশ দূতাবাস চালু করল এবং এর মধ্যদিয়ে ইরান ও ব্রিটেনের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ইরানে ব্রিটিশ দূতাবাসের শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে অজয় শর্মা চার্জ দ্যা অ্যাফেয়ার্সের দায়িত্ব পলন করবেন। দূতাবাস চালুর পর তেহরানে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মাদ জাওয়াদ জারিফ এবং ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ড।

এতে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ইরানে আসতে পেরে তিনি উচ্ছ্বসিত। তিনি দূতাবাস চালু করাকে ইরান ও ব্রিটেনের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রথম ধাপ হিসেবে উল্লেখ করেন। তেহরান ও লন্ডনের মধ্যে নানা ইস্যুতে সংলাপের ক্ষেত্রে দু দেশের দূতাবাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলেও তিনি ঘোষণা দেন।

সংবাদ সম্মেলনে হ্যামন্ড জানিয়েছেন, ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলেই তারা বিনিয়োগ করবেন। এসময় ফিলিপ হ্যামন্ড আরো বলেছেন, ইরানের সঙ্গে ছয় জাতিগোষ্ঠীর যে পরমাণু ইস্যুতে চুক্তি হয়েছে তা তেহরান ও লন্ডনের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

উল্লেখ্য, গত ১৪ বছরের মধ্যে ফিলিপ হ্যামন্ড হচ্ছেন তেহরান সফরকারী শীর্ষ পর্যায়ের ব্রিটিশ কর্মকর্তা। এর আগে, ২০০৩ সালে ব্রিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্বশেষ ইরান সফর করেছিলেন।

ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন সরকার ২০১১ সালে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর তাতে সাড়া দিয়ে ব্রিটেনও তেহরানের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয়। এর প্রতিবাদে একদল বিক্ষোভকারী তেহরানে ব্রিটিশ দূতাবাসের ওপর চড়াও হয়। এ ঘটনার পরপরই ব্রিটিশ সরকার তেহরানে তাদের দূতাবাস বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। দূতাবাস বন্ধ করার পর ইরানের সঙ্গে ব্রিটেনের কূটনৈতিক সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে যায়; তবে দু দেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে নি।

ইরানের সঙ্গে ছয় জাতিগোষ্ঠীর পরমাণু চুক্তি হওয়ার পর এরইমধ্যে জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, সুইজার‍ল্যান্ডসহ পশ্চিমা অনেকগুলো দেশের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রতিনিধিদল ইরান সফর করেছে। অবস্থাদৃষ্টে বলা যায়- ব্রিটেন একটু পেছনেই পড়ে রয়েছে। সেক্ষেত্রে ব্রিটেনের সর্বোচ্চ কূটনীতিক নিজেই বাণিজ্য প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়ে তেহরানে হাজির হয়েছিলেন।

২০১৩ সালে ইরান ও ব্রিটেন সম্পর্ক উন্নয়নের অংশ হিসেবে চার্জ দ্যা অ্যাফেয়ার্স নিয়োগ দেয়। তবে, ইরানের চার্জ দ্যা অ্যাফেয়ার্স ব্রিটেনে থাকেন না; আবার ব্রিটিশ চার্জ দ্যা অ্যাফেয়ার্সও ইরানে থাকেন না। তার আগে, গত বছরের জুন মাসে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ তেহরানে ব্রিটিশ দূতাবাস খোলার প্রস্তাব দেন। কিন্তু কৌশলগত কারণে সে প্রস্তাব বাস্তবায়ন করে নি ব্রিটেন। এর মধ্যে ভিসা জটিলতার মতো একটি বিষয় রয়েছে বলে মনে করা হয়।

বিবিসি দাবি করেছে, সম্প্রতি তাদের সাংবাদিক কিম গাত্তাস এক সপ্তাহ তেহরানে অবস্থান করে সংবাদ পাঠিয়েছেন এবং ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাসুমেহ এবতেকাররের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। ২০০৯ সালের পর এই প্রথম বিবিসি’র কোনো সাংবাদিক তেহরান থেকে সংবাদ সংগ্রহ করে তা ব্রিটেনে পাঠালেন।

দু’দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হলেও মানবাধিকার ইস্যুতে আগের সেই ব্যবধান থেকেই যাবে। এ সম্পর্কে ইরানের চার্জ দ্যা অ্যাফেয়ার্স বলেছেন, “মানবাধিকার ইস্যুতে আমাদের অবস্থান খুবই পরিষ্কার। শুধু ব্রিটেন কেন গোটা ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে এ ইস্যুতে আলোচনা করতে আপত্তি নেই। তবে মুশকিলটা হলো মানবাধিকার ইস্যুকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।”হাবিবুল্লাহজাদেহ বলেছেন, যখন মানবাধিকার ইস্যুকে রাজনীতিকীকরণ করা হয় তখন এ ইস্যুতে অভিন্ন অবস্থানে পৌঁছানো সত্যিই কঠিন হয়ে পড়ে।

 

ইরান ও ব্রিটেনের দূতাবাস চালুর পর ব্রিটিশ পর্যটক এবং মাজার জিয়ারতকারীদের জন্য ভিসা ইস্যু করা হবে। তিনি জানিয়েছেন, মাজার জিয়ারতকরীদের ভিসা ফি এক-তৃতীয়াংশ কমানোর পরিকল্পনা নিয়েছে ইরান সরকার।

 

আমেরিকার খবর কী?

 

ব্রিটেনের সঙ্গে ইরানের কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার খবর বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ কথা আলোচনা হতে শুরু করেছে যে, আমেরিকার সঙ্গেও কী তাহলে তেহরানের সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে? এ ধরনের প্রশ্ন উত্থাপনের মূল কারণ হচ্ছে- ব্রিটেনের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সামরিক অভিযানসহ যেকোনো বড় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গেলে ব্রিটেনের পক্ষ থেকে অকুণ্ঠ ও নিঃশর্ত সমর্থন পেয়ে আসছে আমেরিকা।

 

ইরানে ইসলামি বিপ্লব-পরবর্তী ঘটনাবলী পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ব্রিটেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মার্কিন নীতি অনুসরণ করেছে। এ কারণে পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে আমেরিকার পরেই ব্রিটেনকে ‘শত্রুদেশ’মনে করে ইরান। যাহোক, ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে ইরান ও ব্রিটেনের কূটনৈতিক সম্পর্ক নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়েছে। কখনো সম্পর্ক ভেঙেছে, আবার তা জোড়া লগেছে। কিন্তু ১৯৮০ সালের দিকে আমেরিকার সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর আর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হয়নি। সে কারণে নির্দ্বিধায় বলা যায় ইরান ও আমেরিকার মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক খুব সহজে প্রতিষ্ঠিত হবে না।

 

ইরান দীর্ঘদিন ধরে সুস্পষ্ট ভাষায় বলে আসছে, বিশ্বের প্রধান বলদর্পী শক্তি হচ্ছে আমেরিকা। এই দেশটির সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী নীতির কারণে বিশ্বের বেশিরভাগ সমস্যা তৈরি হয়েছে। আমেরিকা ও ইসরাইল ছাড়া বিশ্বের যেকোনো দেশের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক হতে পারে বলেও বহুবার তেহরান ঘোষণা করেছে।

 

এছাড়া, তেহরান মনে করে- আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমেরিকা হস্তক্ষেপের নীতি অনুসরণ করে আসছে। ইরান এ ধরনের নীতির চরম বিরোধী এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিদ্বন্দ্বী। ইরান বলে আসছে, বিশ্বের যে অঞ্চলের সমস্যা সেই অঞ্চলের দেশগুলো মিলে সমাধান করবে। পক্ষান্তরে আমেরিকা আঞ্চলিক দেশগুলো হস্তেক্ষেপের নীতি বহাল রেখেছে।

 

ইসরাইলের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কও একটি ফ্যাক্টর। ইরান ইসরাইলকে কোনো বৈধ রাষ্ট্র মনে করে না। অন্যদিকে, ইসরাইলকে অস্ত্র ও অর্থসহ সব ধরনের সমর্থন দিয়ে শক্তিশালী করেছে প্রধানত আমেরিকা। আবার আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ইহুদি লবির ব্যাপক প্রভাব রয়েছে যার বাইরে যাওয়া মার্কিন সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে অনেক কঠিন। সর্বোপরি কূটনীতির আড়ালে রয়েছে মার্কিন গুপ্তচরবৃত্তির প্রশ্ন।

 

এছাড়া, সিরিয়া ও ইরাকের চলমান সংকট, আইএসআইএল ইস্যু, হামাস ও হিজবুল্লাহ প্রসঙ্গ, আরব বিশ্বে মার্কিন অস্ত্রের বাজার- এসবই বিবেচিত হবে ইরানের সঙ্গে আমেরিকার কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে। এসব ইস্যুর সমাধান রাতারাতি হবে না। ফলে ইরানের সঙ্গে আমেরিকার কূটনৈতিক সম্পর্ক নিকট ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠার কোনো সম্ভাবনা নেই।

 

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীও গত ১৮ আগস্ট বলেছেন, আমেরিকাকে ইরানের ভেতরে অনুপ্রবেশের সুযোগ দেয়া হবে না। তিনি আরো বলেছেন, “আমরা নিশ্চিতভাবে তাদের পথ বন্ধ করে দেব। আমরা ইরানের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আমেরিকাকে হস্তক্ষেপ করতে দেব না। আমাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে তাদের অনুপ্রবেশ রুখে দেব।”

 

মধ্যপ্রাচ্যের চলমান ঘটনাবলী নিয়ে আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী বলেছেন, নিজের লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমেরিকা এ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়, কিন্তু ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ওয়াশিংটনের এ নীতি প্রতিহত করবে। এ অঞ্চলে যারাই ইসরাইলের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে তাদেরকেই ইরান সর্বাত্মক সমর্থন দেবে বলেও তিনি ঘোষণা করেছেন।

 

উল্লেখ্য, আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী হচ্ছেন ইরানের সুপ্রিম লিডার বা সর্বোচ্চ নেতা এবং তার নির্দেশ ও পরামর্শ মোতাবেক দেশটির বেশিরভাগ নীতি নির্ধারিত হয়ে থাকে। তার অবস্থান যখন সরাসরি মার্কিনবিরোধী; সে কারণে আমেরিকার সঙ্গে ইরানের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কথা ভাবা নিতান্তই বাতুলতা। বড় জোর বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হতে পারে।

 

(মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব। এর সাথে টাইমনিউজবিডির সম্পাদকীয় নীতিমালার কোন সম্পর্ক নেই)

 


সর্বশেষ খবর