তনুর লাশ উদ্ধারের স্থানটির মাটি ও ঘাস কেটে নিয়েছে র্যাব
স্টাফ রিপোর্টারঃ কুমিল্লা সেনানিবাসে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর লাশ উদ্ধারের স্থানটির অন্তত ছয় ফুট মাটি ও ঘাস কেটে নিয়ে গেছে র্যাব।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও জেলা পুলিশের কাউকে কিছু না জানিয়ে গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা থেকে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসানের নেতৃত্বে র্যাবের একটি দল এ মাটি ও ঘাস নিয়ে যায়।
এ ঘটনায় বিস্মিত, ক্ষুব্ধ ও হতাশ কুমিল্লা জেলা পুলিশের কর্মকর্তারা। স্পর্শকাতর স্থানটির মাটি নিয়ে যাওয়ায় অপরাধী শনাক্ত কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
অন্যদিকে শিক্ষার্থী তনু হত্যার ১০ দিনেও হত্যার রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি। এ অবস্থায় জেলা গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি) তদন্তের দায়িত্ব দেওয়ার দুই দিনের মাথায় আবারও তদন্ত সংস্থা পরিবর্তন করা হয়েছে। গতকাল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তদন্তের অংশ হিসেবে পুনঃ ময়নাতদন্তের জন্য আজ তনুর মৃতদেহ কবর থেকে ওঠানো হবে।
পুলিশ ও র্যাবের একাধিক সূত্র জানায়, গতকাল সকালে ঢাকা থেকে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসানের নেতৃত্বে র্যাবের একটি টিম কুমিল্লা সেনানিবাসের পাহাড় হাউস এলাকায় এসে পৌঁছে। এই পাহাড় হাউস এলাকার একটি কালভার্টের পাশে ঝোপের মধ্যে তনুর মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। র্যাবের দলটি সেই স্থানটির প্রায় ছয় ফুট মাটি ও ঘাস কেটে নিয়ে যায়।
সূত্র মতে, স্পর্শকাতর এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদের না জানিয়েই এ ঘাস ও মাটি কেটে নেওয়া হয়। তবে তারা কেন এ কাজ করেছে তা জানতে পারেননি মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও। এ বিষয়ে কিছু জানাতে পারেননি কুমিল্লার পুলিশ সুপার শাহ আবিদ হোসেনও।
এ ব্যাপারে র্যাব কুমিল্লার ক্রাইম প্রিভেনশন কম্পানি-২-এর কর্মকর্তা খুরশেদ আলম বলেন, তদন্তের অংশ হিসেবে মাটি সংগ্রহ করা হয়। র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসানের নেতৃত্বে মাটি কেটে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি তিনি স্বীকার করেন।
র্যাবের মাটি তুলে নিয়ে যাওয়ার পর ঢাকা থেকে আসা সিআইডির একটি তদন্ত দল গতকাল সেনানিবাস এলাকার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কুমিল্লা পৌঁছে সিআইডির দলটি প্রথমে পুলিশ সুপার মো. শাহ আবিদ হোসেনের সঙ্গে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে বৈঠক করে।
বৈঠকে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার নাজমুল করিম, কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভুইয়া, আবদুল্লাহ আল-মামুন, ডিবির ওসি এ কে এম মনজুর আলম উপস্থিত ছিলেন। পরে পুলিশ সুপার শাহ আবিদ হোসেন, জেলা পুলিশের অন্য শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারাসহ সিআইডির দলটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। সিআইডির দলটির সঙ্গে থাকা একটি সূত্র জানিয়েছে, তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে তনুর মৃতদেহ পড়ে থাকার স্থানটির মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া দেখে বিস্মিত হন।
তনু হত্যা মামলার বিষয়ে পুলিশ সুপার শাহ আবিদ হোসেন গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, মামলাটির তদন্তভার সিআইডিকে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সিআইডির একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। এখন আমরা সিআইডি আরেকটি দলের অপেক্ষায় আছি।’
বিভিন্ন সূত্র জানায়, নিহত তনুর লাশের কাছে পাঁচটি কনডমের খালি প্যাকেট পাওয়া গেছে। সে প্যাকেটগুলো ফুলের মতো সাজানো ছিল। আর এই কনডমগুলো ছিল ‘নিরাপদ’ ব্র্যান্ডের কনডম। তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধারণা, ঘটনাস্থলে ধর্ষণ বা হত্যাকাণ্ড ঘটে থাকলে কনডমগুলো এভাবে পড়ে থাকত না। দুর্বৃত্তরা মামলাটি ভিন্ন খাতে নিতে এ কাজ করে থাকতে পারে।
আজ লাশ উত্তোলন : পুলিশ ও প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, আজ সকাল ১০টার দিকে তনুর মৃতদেহ উত্তোলন করা হবে। একজন প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে তদন্তদল আজ কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে যাবে।
কুমিল্লায় বিক্ষোভ : এদিকে তনু হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার দাবিতে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থীরা কলেজের শহীদ মিনারের ‘তনুমঞ্চে’ বিক্ষেভ কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। গতকাল সকাল ১০টায় কলেজ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত এই মানববন্ধন কর্মসূচিতে সাধারণ শিক্ষার্থীসহ, থিয়েটারের নাট্যকর্মীরা অংশগ্রহণ করেন। কর্মসূচি শেষে শিক্ষার্থীরা তনুমঞ্চে (কলেজের শহীদ মিনার) মুখে কালো কাপড় বেঁধে অবস্থান সমাবেশ করে।
সিলেটে বিক্ষোভ : তনুর খুনিদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে গতকাল সিলেটে ‘আমরা তনুর ভাইবোন’ ব্যানারে নগরের কিনব্রিজ এলাকা থেকে মৌন মিছিল বের করে শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে আয়োজিত মানববন্ধনে অংশ নেয় ৩০টি সামাজিক সংগঠন।
ঢাকায় অবরোধ : তনুকে ধর্ষণ ও হত্যাকারীদের বিচার দাবিতে গতকাল দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল বের করে শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি দুপুর ১টায় শাহবাগ মোড় অবরোধ করে। এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে ঢাকা কলেজ, নটর ডেম কলেজ, রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ, ইব্রাহিম মেডিক্যাল কলেজ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে প্রতিবাদে যোগ দেয়।
কর্মসূচি চলাকালে সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তার একটি গাড়ি দেখে চড়াও হয় শিক্ষার্থীরা। পরে পুলিশ গাড়িটি উদ্ধার করে। অবরোধ শেষে আগামী ৩ এপ্রিল দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে একাত্মতা প্রকাশ করে প্রগতিশীল ছাত্রজোট ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্য।
আজ সারা দেশে মানববন্ধন : তনু হত্যার প্রতিবাদে আজ গণজাগরণ মঞ্চের পূর্বঘোষিত দেশব্যাপী সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত একযোগে মানববন্ধন করা হবে।
ঘটনাস্থলে যাচ্ছেন ড. মিজান : তনু হত্যার ঘটনাস্থল পরিদর্শনের জন্য আজ কুমিল্লা সেনানিবাসে যাচ্ছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। গতকাল সিরডাপ মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান।
ঢাকায় আরো প্রতিবাদ : গতকাল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের উদ্যোগে মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি সম্পন্ন হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি প্রাঙ্গণে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশে করে। জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য দেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ, পথনাটক পরিষদের সভাপতি মান্নান হীরা প্রমুখ। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে সাংস্কৃতিক সংগঠন কলরব।
উত্তরায় শুভসংঘের মানববন্ধন : তনু হত্যার বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করেছে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি (আইইউবিএটি) এবং উত্তরা ইউনিভার্সিটি শুভসংঘের বন্ধুরা। প্রায় পাঁচ শ শিক্ষার্থী গতকাল সকালে উত্তরার আজমপুর থেকে হাউস বিল্ডিং পর্যন্ত দীর্ঘ মানববন্ধন তৈরি করে। শুভসংঘ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি শাখার সভাপতি মো. আবদুর রাজ্জাক খানের নেতৃত্বে মানববন্ধনটি পরিচালনা করা হয়। এতে শুভসংঘের বন্ধু সহসভাপতি সজীব হোসাইন, সাধারণ সম্পাদক সাইদুল ইসলাম রানা, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং ক্লাবের উপদেষ্টা কুতুব উদ্দিন ও আল আমিন এবং সভাপতি মো. রবিন প্রমুখ মানববন্ধনে অংশ নেন।
ধৈর্য ধরার আহ্বান পুলিশের : গতকাল পুলিশ সদর দপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সড়ক অবরোধের মাধ্যমে আন্দোলন না করে ধৈয্য ধরার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ক্লুলেস এই মামলার রহস্য উদ্ঘাটনে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে কাজ শুরু করেছে।
আন্দোলনকারীদের অনুভূতি ও দাবিকে যথাযথভাবে সম্মান করে পুলিশ সদর দপ্তর। বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, ‘কোন হত্যাকান্ডের জড়িত আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য কোন আন্দোলন বা বিক্ষোভের প্রয়োজন নেই। এটা পুলিশের পেশাগত ও নৈতিক দায়িত্ব।’
দায়িত্বশীল বক্তব্যের আহ্বান সেনাবাহিনীর : গতকাল আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তনু হত্যাকাণ্ডে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী প্রথম থেকেই সব তদন্তকারী সংস্থাকে আন্তরিকভাবে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে আসছে।
অথচ কিছু স্বার্থান্বেষী মহল এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেনাবাহিনী সম্পর্কে অনুমান নির্ভর বক্তব্য প্রচার করছে এবং জনমনে বিভ্রান্তি ছাড়ানোর চেষ্টা করেছেন যা মোটেই কাম্য নয়। এ ব্যাপারে সবার দায়িত্বশীল বক্তব্য প্রচার একান্তভাবে কাম্য। সেনাবাহিনীও প্রত্যাশা করে দোষী ব্যক্তিদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হোক। সূত্র- কালের কন্ঠ,