পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বড় বিনিয়োগের হাতছানি
আমারবাংলা ডেস্কঃ অতালিকাভুক্ত বন্ড, ডিবেঞ্চার, প্রেফারেন্সিয়াল শেয়ার ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডে ব্যাংক কম্পানির বিনিয়োগ নীতিমালা শিথিলের কারণে পুঁজিবাজারে সম্ভাবনা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। তাঁরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন সিদ্ধান্তে পুঁজিবাজারে দেশের তফসিলি ব্যাংকের আরো বড় বিনিয়োগের পথ সুগম হলো। আর বিনিয়োগ এলে পুঁজিবাজারে তারল্য সংকট কাটার পাশাপাশি ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে এবং ব্যাংকের শেয়ার কেনার সক্ষমতাও বাড়বে।
২০১০ সালে ধসের পর পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ বিষয়ে শক্ত অবস্থানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ ওই সময় ব্যাংক নিয়মনীতি উপেক্ষা করে বাড়তি বিনিয়োগ করে। পরবর্তী সময়ে বাজারে বড় ধসে লাখো বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর পুঁজিবাজার সংস্কারের উদ্যোগ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের অফ সুইট সুপারভিশন বিভাগ থেকে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে পৃথক দুটি সার্কুলার জারি করে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা গণনা নির্দিষ্ট করা হয়।
জানা যায়, আমানত সংগ্রহ ও উদ্যোক্তাদের ঋণ জোগানের বাইরেও বন্ড, ডিবেঞ্চার ও একাধিক প্রতিষ্ঠানে ব্যাংকের কৌশলগত বিনিয়োগ থাকে। কিন্তু পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ হিসাবে তালিকাভুক্ত নয় এমন শেয়ারে বিনিয়োগও গণনা করা হয়। বর্তমান অবস্থা ও সরকারের মতামতের ভিত্তিতে পুঁজিবাজারে ব্যাংক কম্পানির বিনিয়োগ নীতিমালা শিথিল করে গত ১৬ মে বিনিয়োগসংক্রান্ত নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যাতে তালিকাভুক্ত নয় এমন ইক্যুইটি শেয়ার, প্রেফারেন্স শেয়ার, বন্ড, ডিবেঞ্চার ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডে ব্যাংকের বিনিয়োগ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগসীমার বাইরে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক আমানত সংগ্রহ ও ঋণ জোগানের বাইরে বন্ড, অগ্রাধিকারমূলক শেয়ার, ডিবেঞ্চার ও দীর্ঘ মেয়াদে কৌশলগত বিনিয়োগ থাকতেই পারে, কিন্তু এসব তালিকাভুক্ত না হলেও পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা গণনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যা পুঁজিবাজারে তারল্য প্রবাহে বাধা সৃষ্টি ও ব্যাংকের বিনিয়োগ সংকুচিত করে।
সূত্র জানায়, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগসীমাসংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞায় ব্যাংকও ধীরে চলা নীতি অনুসরণ করে। কারণ বিনিয়োগসীমা অতিক্রম করলেই বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে জরিমানা করে। সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার ভয়েও ব্যাংক সীমিত আকারে বিনিয়োগ করে। বর্তমানে পুঁজিবাজারে তারল্য সংকট চলছে। বিনিয়োগসংক্রান্ত জটিলতায় বাজার নিম্নমুখী হলেও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এক্সপোজার ইস্যুতে বিনিয়োগ বাড়াতে পারছে না। কাজেই এই সময়ে পুঁজিবাজার গতিশীল করতে অতালিকাভুক্ত বন্ড, ডিবেঞ্চার ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডে ব্যাংকের বিনিয়োগ ছাড় সময়ের দাবিতে পরিণত হয়। সরকারের উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার জরুরি বৈঠকে বিস্তর আলোচনার পর ছাড় দিতে সম্মত হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ হিসাব গণনায় ছাড় দিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানায় ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন। ওই সময় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত পুঁজিবাজারের অবস্থা বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠিও দেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় ঝুলে থাকার পর গত বৃহস্পতিবার একটি সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এই নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকের বিনিয়াগসীমা হিসাবায়নে সমন্বিত বা কনসলিডেটেড ভিত্তি গণনায় পুঁজিবাজারে তারল্য প্রবাহের ক্ষেত্রে অধিকতর সংকোচনমূলক হয়েছে। আর ব্যাংকের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণমূলক হয়েছে। যার জন্য দীর্ঘ সময় ধরেই এই দাবি জানিয়ে আসছে সংশ্লিষ্টরা, কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক সে বিষয়ে কর্ণপাত করেনি।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের দাবি ছিল, সমন্বিতভাবে বা কনসলিডেটেড ভিত্তিতে এক্সপোজার গণনা না করে সলো ভিত্তিতে গণনা করতে হবে। আর ব্যাংক কম্পানি আইন ১৯৯১-এর ২৬(ক) ধারা অনুযায়ী যেসব সিকিউরিটিজের বাজারমূল্য নেই সেসব অন্তর্ভুক্ত না করা। অর্থাৎ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয় বন্ড, ডিবেঞ্চার, প্রেফারেন্সিয়াল শেয়ার ও অতালিকাভুক্ত মিউচ্যুয়াল ফান্ডকে এক্সপোজারের বাইরে রাখা। এ ছাড়া কৌশলগত বিনিয়োগ, যা পুরো মেয়াদকাল পর্যন্ত ধারণকৃত ও যেসব সিকিউরিটিজের কোনো লেনদেন হয় না, সেসবকে এক্সপোজার গণনায় বাদ রাখা।
দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এই সার্কুলারকে পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক আখ্যা দিয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক ও বিএলআই সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন কালের কণ্ঠকে বলেন, পুঁজিবাজারে তারল্যপ্রবাহ বাড়বে, কাটবে তারল্য সংকটও। পুঁজিবাজারে ব্যাংকের শেয়ার কেনার সক্ষমতাও বাড়বে, যা পুঁজিবাজারে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। কারণ ব্যাংক এই এক্সপোজারের কারণে শেয়ার কিনতে পারেনি, যা এখন পারবে। এতে নতুন বিনিয়োগ যেমন আসবে, তেমনি শেয়ার কেনারও আগ্রহ বাড়বে।’
তিনি বলেন, এক্সপোজারে হিসাব গণনায় অতালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজে যে ছাড় দেওয়া হয়েছে সেই সুবিধা ব্যাংক পুঁজিবাজারে কাজে লাগাবে। এই অর্থে নতুন করে তারা শেয়ার কিনতে পারবে। কম দামেও নতুন শেয়ার কেনার সুযোগ পাবে। বিভিন্ন মার্চেন্ট ব্যাংক ও অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীও সক্রিয় হতে পারবে। ব্যাংকের হিসাব ক্যালকুলেশনে বাড়তি ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। আর এটা এলে বাজারে তারল্যপ্রবাহ বাড়বে। আর এতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।