বাংলাদেশ ক্রিকেট দল নিয়ে মন্তব্য? সম্ভব না, একেবারেই না
খেলাধুলা ডেস্কঃ কারো সঙ্গে দেখা হলেই এক প্রশ্ন, ‘বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কেমন করবে?’
বিশ্বকাপের চাদর গায়ে দেওয়া সময়ে এমন প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক নয়। আর মানুষ সাংবাদিকদের মত জানতে সব সময়ই আগ্রহী খুব। বেশির ভাগের ধারণা এদের কাছে বাড়তি তথ্য আছে। সব লেখে না। কিছু কিছু লুকিয়ে রাখে। ঠিকমতো ধরতে পারলে জানা যায়।
ইদানীং অবশ্য আরেকটি কারণে সাংবাদিকদের মতামত শুনে রাখতে চায়। পরে না মিললে বলা যাবে, অমুক সাংবাদিক বলেছিল বাংলাদেশ এই করবে। যত্তসব।
মত দেওয়া তাই ঝুঁকির। তবু এই ঝুঁকির কাজটাই কি ২৫ বছর ধরে করে আসছি না! সাংবাদিকদের কাজই তো কথা বলা। মত প্রকাশ করা। তা একটা ফর্মুলা মেনে মতামতটা দিচ্ছি। খুব আশাবাদী কাউকে পেলে, মানে বাংলাদেশ এবার বিশ্বকাপ জিতেই যাবে টাইপের হলে বলি, ‘সম্ভাবনা আছে। খেলতে হবে পুরো শক্তি দিয়ে।’
আবার যারা হতাশ ধরনের, তাদের ক্ষেত্রে বক্তব্যটা হয় এ রকম, ‘সতর্ক থাকাই ভালো। বিশ্বকাপ তো অনেক হিসাবনির্ভর।’
কেন প্রশ্নকর্তামুখী মতামত? কারণ, এত বছরে এই জিনিসটা বুঝেছি যে, কোনো দল বা ফল নিয়ে আগাম মন্তব্য করা যেতে পারে বটে কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এবং বিশ্বকাপ! না, সম্ভব না। একেবারেই না।
২. ২০০৭ সালে বিশ্বকাপে যেতে গিয়ে পড়লাম এক হুলুস্থুলের মধ্যে। দুবাইতে রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়েছিল বাংলাদেশ বিমান, ফলে ভেঙে পড়ল ওখানকার সূচি। আমাদের ফ্লাইট ছিল ঢাকা-দুবাই-লন্ডন-বার্বাডোজ-ত্রিনিদাদ। বিমানের কীর্তির মাসুল দিতে গিয়ে প্রতিটি কানেকটিং ফ্লাইট মিস করে প্রতিটি দেশে একেক দিন করে থাকতে হলো আর তাতে তিন দিন পর ত্রিনিদাদের রাজধানী পোর্ট অব স্পেনে পৌঁছে পাঠানো প্রথম লেখাটার শিরোনাম ছিল, ‘বিশ্ব ঘুরে বিশ্বকাপে।’ বিশ্ব ঘোরার সেই অনুভূতির চোটটা এক ধাক্কাতেই বিশ্বজয়ের অনুভূতিতে রূপান্তরিত হয়ে গেল, যখন বাংলাদেশ দলের হোটেলে পৌঁছে দেখলাম সবার মধ্যেই একটা অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস। প্রথম ম্যাচে ভারতকে হারিয়ে দেবে। বাংলাদেশ বহু ম্যাচ জিতেছে আগে-পরে, কিন্তু কোনো বড় ম্যাচের আগে অতটা বিশ্বাস দেখিনি। মনে আছে, ম্যাচ শেষে এক ভারতীয় সাংবাদিক রাহুল দ্রাবিড়কে প্রশ্ন করেছিলেন, বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২০ দলের কাছে হারার অনুভূতি কেমন?
ফেভারিট হিসেবে খেলতে এসে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়ার বেদনায় দ্রাবিড়ের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। এতটাই হতাশা। এর মধ্যে এই অপমানের কাঁটায় লাল হয়ে গেলেন। তবু ভদ্রলোক মানুষ। সামলে নিয়ে বললেন, ‘সত্যিই বাংলাদেশের পরের প্রজন্ম খুবই প্রতিভাবান। আশা করি, ওরা বাংলাদেশকে অনেক দিন টেনে নিয়ে যাবে।’
যদিও মাশরাফি সেই ম্যাচের মূল নায়ক তবু সাকিব-তামিম আর মুশফিক বিরাট ভূমিকা রেখেছিলেন জয় নিশ্চিত করাতে। তিনজনেরই বয়স তখন ২০ এর নিচে বলে এই প্রশ্ন। যা-ই হোক, রাহুল দ্রাবিড়ের কথাটাকে তখন মনে হচ্ছিল অধিনায়কোচিত ভদ্রতা কিন্তু আজ এক যুগ পর মনে হয়, দ্রাবিড়ও বোধ হয় ভাবেননি এদের কাঁধে চড়ে এত দূর পৌঁছে যাবে বাংলাদেশের ক্রিকেট।
তরুণদের স্ফুরণ, সুপার এইটে উত্তরণ—এসব কিছুর কথাই সবাই বলবে সেই বিশ্বকাপ প্রসঙ্গে। কিন্তু সত্যি বললে, এর বাইরে অন্য একটি ব্যাপারই বেশি মুগ্ধ করেছিল। সাকিব-তামিমদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেখলাম খেলায় যতটা মানসিকতায় ওরা তার চেয়েও বেশি আলাদা আগের প্রজন্মের চেয়ে। আগের প্রজন্ম যেমন প্রতিপক্ষের তারকাখ্যাতিতে নুইয়ে পড়তেন, এদের মধ্যে দেখলাম ওসব নিয়ে বাড়তি কোনো মোহ নেই। টেন্ডুলকার-লারাও তাদের কাছে স্রেফ দুজন প্রতিপক্ষই। লারার দেশে বসে নিশ্চিত হয়ে গেলাম, নতুন দিন আসছে। নতুন পথে যাত্রা শুরু হলো এবার।
১৯৯৯ সালে প্রথম বিশ্বকাপে তৈরি হয়েছিল অনেক কিছুর ভিত। মাঝের ২০০৩ বিশ্বকাপ কেড়ে নিয়েছিল অনেকখানি। ২০০৭ ক্ষতিপূরণই করল না, নতুনদের দিয়ে নতুন রসায়নও তৈরি করে দিল। যেমন দিল ২০১৫ বিশ্বকাপ। এবার আমরা ঘরের মাটির দলের খোলস ছাড়লাম। ভেতরের ঘুমন্ত শক্তি জেগে গিয়ে জানাল, বিদেশেও এখন পারা যায়।
এভাবেই বিশ্বকাপ থেকে বিশ্বকাপ পরিক্রমায় তৈরি হয়েছে আমাদের রাস্তা। যে বিশ্বকাপ কিছু দেয়নি, সেটাও এই শিক্ষা দিয়েছে যে বদলাতে হবে অনেক কিছু। অন্যগুলোতে পাথেয় মিলেছে। জ্বালানি মিলেছে।
২০১১ বাদ পড়ল যে…। বাদ পড়েনি, এর আরো বড় তাত্পর্য রয়েছে বলে আলাদা করে আসছি।
৩. মুম্বাই বিমানবন্দরে নেমে ব্যাগ আটকে যাওয়াতে কাস্টমসের এক নিরাপত্তারক্ষীকে হাতে নেওয়ার চেষ্টা করতে হলো। ভারতে যেকোনো মানুষের সঙ্গে খাতিরের উপায় হচ্ছে, বলিউড বা ক্রিকেট নিয়ে গল্প জুড়ে দেওয়া জানতাম। বিশ্বকাপ মৌসুম, তার ওপর নিজের বিষয় ক্রিকেট, সেটা ধরেই এগোলাম। আর তাতে আরেকটু হলে ব্যাগটা স্থায়ীভাবে হাতছাড়া হওয়ার জোগাড়। গণেশ সিং বা এই জাতীয় নামের মানুষটি পুরোপুরি ক্রিকেটবিমুখ। শুধু ক্রিকেট খেলা দেখতে গুচ্ছের টাকা খরচ করে ভারতে চলে গেছি দেখে সে বিস্মিত। যখন জানালাম, আমি নয়, আমার কম্পানি আমার খেলা দেখার ব্যয় বহন করেছে তখন এমনভাবে তাকাল যেন পৃথিবীতে এমন আহাম্মক কম্পানিও আছে যারা এভাবে টাকার অপচয় করে।
মুম্বাই থেকে চণ্ডীগড় যেতে যেতে হিসাব মেলাতে চেষ্টা করলাম, পরদিন ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ অথচ তা নিয়ে এমন অনাগ্রহও আছে। গণেশ সিং কি অন্য গ্রহের মানুষ। এবং মোটেও তা নয়। খেয়াল করে দেখলাম ভারতীয়দের যে ক্রিকেটমুখিতা নিয়ে আমরা মোহিত তাতে ভাটার টান। বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনাও আসে। মাত্র পাঁচটি ম্যাচ হয়েছে বাংলাদেশে। তাই নিয়ে পুরো দেশের উল্লাসের তুলনায় ভারতের উত্তেজনা কিছুই না। মানে, ভারতকে পেছনে ফেলে ক্রিকেটের উত্সাহে বাংলাদেশ এক নম্বর।
সেটাই শুধু নয়। সেই বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল-ফাইনাল সূত্রে ভারত ভ্রমণের আরেকটি দিকের দিকেও নিয়ে গেল দৃষ্টিভঙ্গি। যদিও ভারত বিশ্বকাপ জিততে চলেছে তবু আলোচনায় ঘুরে-ফিরে আসছে আইপিএল। টি-টোয়েন্টিতেই যে ক্রিকেটের ভবিষ্যত্ এটা মেনে নিয়ে সেই মতোই এগোচ্ছে ক্রিকেট বাজারের দেশের পথ।
পরের আট বছরে সেই সত্যটা আরো স্পষ্ট হয়েছে। ক্রিকেট এগোচ্ছে টি-টোয়েন্টির পথে। সেই চাপে অন্যরা যখন ওয়ানডেকে সেছলের মতো করে দেখছে, তখন বাংলাদেশেই ওয়ানডে সাদরে লালিত। ওয়ানডের বিশ্বকাপ কি সেই অর্থে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ নয়! অন্যরা ছাড়তে চাইছে অথচ আমরা বুকে আগলে রাখতে চাইছি।
খেলার প্রাণ নেই। ভালোবাসার মর্ম বোঝার সামর্থ্যও থাকার কথা নয়। কিন্তু মাঝেমধ্যে তো দেখতে পাই প্রাণময় বিচারকের মতো করে বুঝিয়ে দেয় ভালোবাসার দেনা। চুকিয়ে দেয় পুরনো বকেয়া।
ক্রিকেট ভালোবাসায় আমরা এক নম্বর। ওয়ানডে ক্রিকেটের আশ্রয়ভূমিও এখন বাংলাদেশ।
বিশ্বকাপ ক্রিকেটের কিছু দেনা তো জমে গেছে মনে হয়।
৪. জীবদ্দশায় কিছু জিনিস দেখব কল্পনাও করিনি। এমন তীব্র আওয়ামীবিরোধী অপপ্রচার চলছিল একটা সময় যে ভাবাই যায়নি আওয়ামী লীগ কোনো দিন আবার ক্ষমতায় আসবে। দশ-বারো বছর থাকার চিন্তা তো যাকে বলে ‘বহুত দূর কি বাত’।
আর তাই সময়ে সবই সম্ভব। যেমন এটাও সম্ভব হয়ে যাচ্ছে যে ইংল্যান্ড একটা বিশ্বকাপে ফেভারিট। এটাও কল্পনার বাইরের ব্যাপার ছিল একসময়। কি ফুটবল, কি ক্রিকেট ইংল্যান্ড খেলবে পুরনো ধ্বজা ধরা ক্রিকেট। সময় এবং আধুনিকতার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই, ওদিকে খেলাগুলো আবিষ্কারের গর্বে একধরনের উচ্চম্মন্যতা থাকবে, সেই বড়ত্ব আর মাঠের ছোটত্ব মিলিয়ে ওরা সব সময়ই হাসাহাসির বিষয়। সেই ইংল্যান্ড এবারের বিশ্বকাপে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর দল। ওদের ব্যাটিং দেখতে লোকে কাজ ফেলে টিভির সামনে বসছে—ইংল্যান্ডের কোনো খেলা নিয়ে এমন কৌতূহল আগে দেখা যায়নি কোনো দিন।
আর এই যে ইংল্যান্ডের ফেভারিট সেজে যাওয়া তাতে বাংলাদেশেরও একটা উজ্জ্বল ভূমিকা। গত বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কাছে হেরে গিয়েছিল ইংল্যান্ড। সেই হারে এমন চাপে পড়ে যে খোলনলচে বদলানোর তাগিদ আসে সব পক্ষ থেকে। বদলেও গেল রাতারাতি। প্রায় সেই দল, শুধু পরাজয়জনিত গ্লানি থেকে অন্তর্গত তাগিদ। সেই মরগান, সেই হেলস, সেই স্টোকস-বাটলার, তবু যেন অন্য দল। বাংলাদেশ টনিক এভাবেই কাজে লেগেছে।
তাতে বাংলাদেশেরও লাভ হয়েছে একটা। নিজেরা ব্যাটিংসর্বস্ব হয়ে যাওয়াতে কন্ডিশনকে ব্যাটিং উপযোগী করতে কোনো আপত্তি নেই। আইসিসিও তা-ই চায়, ক্রিকেট বাণিজ্যের স্বার্থে। দুয়ে মিলে রানপ্রসবা সব উইকেট। বাংলাদেশকে আর সুইং বা বোলিংয়ের বিষ নিয়ে মাথা ঘামাতে হচ্ছে না বিশেষ। মনোযোগ দেওয়া যাচ্ছে রান করা আর স্ট্রোক খেলার দিকে। সেটাই বাংলাদেশের স্বাভাবিক ক্রিকেট দক্ষতা।
৫. কন্ডিশনজনিত সংকট দূর হয়ে যাওয়াতে বাংলাদেশ সর্বস্ব দিয়ে খেলতে পারবে নিজেদের ক্রিকেট। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশ যেকোনো কাণ্ড করে ফেলার দল। সঙ্গে মানুষের ভালোবাসাজনিত শক্তি। সঙ্গে বিশ্বকাপ, ক্রিকেট আর ইংল্যান্ডের দেনা। এসব মিলে গিয়ে স্বপ্নের মইটাকে মাঝে মাঝে আকাশে পৌঁছার মতোই দেখায়।
কাজেই স্বপ্ন দেখাদের সঙ্গে দেখা হলে যে স্বপ্নের পক্ষে থাকছি তাতে নিশ্চয়ই দোষের কিছু হচ্ছে না।
আবার সতর্ক থাকাদের সঙ্গেও তাল দিচ্ছি। কিছু বিরুদ্ধমত থাকাও তো দরকার। নইলে বল্গাহীন স্বপ্নের এমন বিস্তার ঘটবে যে মনে হবে, না খেলে…ঘরে বসেই বোধ হয়…।
ও, হ্যাঁ, শেষ কথাটা হলো যত কিছু পক্ষে থাকুক, মানুষ যতই ভালোবাসার জ্বালানি জ্বালাক, শেষ পর্যন্ত খেলাটা হয় মাঠে। যা করার করতে হয় খেলোয়াড়দেরই।
আর আয়ারল্যান্ডের পর ফাঁকফোকর ভরে গিয়ে দলটাকে এমন তৈরি দেখাচ্ছে যে দ্বিতীয় পর্যায়ের, মানে সন্দেহবাদী মানুষ যারা ছিলেন, তাঁদের সংখ্যা দেখছি দিন দিন কমছে।