সব

বাজেটে মেলে না সংসারের হিসাব

AUTHOR: Primenews24bd Desk
POSTED: Wednesday 12th June 2019at 8:00 am
79 Views

আমারবাংলা ডেস্কঃপ্রতিবছর বাজেটের আকার বাড়ছে। আর সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয়। কিন্তু সেই তুলনায় মধ্যম ও সীমিত আয়ের মানুষের আয় তেমন বাড়ছে না। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে বাড়িভাড়া, শিক্ষা, পরিবহন ও স্বাস্থ্য খাতে চলে যায় তাদের আয়ের বেশির ভাগ। আর সরকারের পক্ষ থেকেও প্রধান এই চার খাতের ব্যয় কমাতে নেই তেমন কোনো পদক্ষেপ। ফলে সংসারের বাকি ব্যয় মেটাতে প্রতিনিয়ত যুদ্ধে নামতে হয়। এতে বাজেটের হিসাবে কোনোভাবেই মেলে না সংসারের হিসাব।

রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীর অভিভাবক শাহানা পারভীন কষ্টের হাসি হেসে জানালেন তাঁর মেয়ের শিক্ষা ব্যয়ের কথা। ‘সামনে জেএসসি পরীক্ষা। তাই মেয়ে দুই শিক্ষকের কাছে কোচিং করছে ও দুজন শিক্ষক বাসায় এসে পড়াচ্ছেন। এ খরচের পাশাপাশি যাতায়াত, স্কুল খরচ, বই-খাতাসহ আনুষঙ্গিক মিলে মেয়ের পড়ালেখার পেছনেই মাসে ২০ হাজার টাকা চলে যায়। ফলে অন্য খরচ কাটছাঁট করে চলতে হয়।’ তিনি জানালেন, ভারতের দার্জিলিংয়ের রকভ্যালি একাডেমিতে পড়ে তাঁর একজন নিকটাত্মীয়ের সন্তান। একই ক্লাসের ওই শিক্ষার্থীর থাকা-খাওয়া মিলিয়েও মাসে ২০ হাজার টাকা খরচ হয় না।

এই পার্থক্যের কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, ভিকারুননিসায় মাসে বেতন এক হাজার ২০০ টাকা। কিন্তু স্কুলে তেমন পড়ালেখা হয় না। স্কুলের শিক্ষকদের কাছেই পড়তে হয় প্রাইভেট-কোচিংয়ে। অথচ দার্জিলিংয়ের রকভ্যালি একাডেমিতে মাসিক বেতন তিন হাজার ৫০০ টাকা (বাংলাদেশি টাকার হিসাবে)। তাঁরা শিক্ষকদের কিছুটা বেশি বেতন দিয়ে প্রাইভেট-কোচিং বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে স্কুলের পড়া স্কুলেই শেষ হচ্ছে। কমে যাচ্ছে শিক্ষা ব্যয়।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে, ২০১৬ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছিল ৬.৪ শতাংশ। পরের দুই বছরে বেড়েছে ৮.৪৪ এবং ৬ শতাংশ হারে। অর্থাৎ তিন বছর আগে ১০০ টাকায় যে পণ্য বা সেবা পাওয়া যেত সেগুলো পেতে এখন কমপক্ষে ১২০ টাকা লাগছে।

জীবনযাত্রার ব্যয় প্রতিবছর বেড়ে চললেও করমুক্ত আয়ের সীমা চার বছর ধরে আড়াই লাখ টাকা। অর্থাৎ ব্যক্তিগত মাসে ২০ হাজার ৮৩৩ টাকা আয় হলেই কর দিতে হচ্ছে।

রাজধানীর মিরপুরের একটি এমপিওভুক্ত স্কুলের সামাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষক সানোয়ার হোসাইন। তাঁর মূল বেতন ২৩ হাজার ১০০ টাকা। এ ছাড়া তিনি বাড়িভাড়া বাবদ এক হাজার টাকা ও মেডিক্যাল ভাতা বাবদ মাসে পান ৫০০ টাকা। তিনি বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে মূল বেতনের সঙ্গে রাজধানীতে ৭০ শতাংশ বাড়িভাড়াসহ অন্যান্য সুবিধা দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের বাড়িভাড়া মাত্র এক হাজার টাকা। অথচ এর পরও আমাদের আয়কর দিতে হয়। একজন আয়কর দাতা হয়েও নিজেই সংসার চালাতে পারছি না।’

বাজেটে প্রবৃদ্ধির কথা থাকে, খাতওয়ারি বরাদ্দ বাড়ে প্রতিবছর, বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প গৃহীত হয়। কিন্তু মধ্য ও সীমিত আয়ের মানুষের আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলানোর মতো প্রত্যক্ষ কর্মসূচি তেমন থাকে না। অবশ্য দারিদ্র্য নিরসন ও সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য সামাজিক সুরক্ষা খাতে ৬৪ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে।

চলতি বাজেটে বলা হয়েছে, প্রতিবছর ২০ লাখ শ্রমশক্তি যুক্ত হচ্ছে দেশে। তাদের বড় অংশ আনুষ্ঠানিক কাঠামোর বাইরে। তাদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হচ্ছে নারী গৃহকর্মী। বাজেটে ‘শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের’ কথা বলা হলেও সেটি পোশাকশিল্পসহ আনুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য। ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি-২০১৫’ প্রণয়নের উল্লেখ রয়েছে চলতি অর্থবছরের বাজেটে, তবে এর সুফল গৃহকর্মীরা কিভাবে পাবে তার উল্লেখ নেই।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে তিন বাসায় কাজ করে মাসে সাত হাজার টাকা পেয়ে আসছেন জাহানারা বেগম। দুই সন্তানকে নিয়ে যে বাসায় থাকেন, তার ভাড়াই তিন হাজার টাকা। মগবাজারের একটি গ্যারেজে কাজ করে মাসে ১২ হাজার টাকা পান হারুন রশিদ। মাসে মেস ভাড়া এক হাজার ৬০০ টাকা, খাওয়ার জন্য তিন হাজার টাকা এবং বাড়িতে পাঠাতে হয় পাঁচ হাজার টাকা। বাদবাকি দুই-আড়াই হাজার টাকা হাতখরচে ব্যয় হচ্ছে। সঞ্চয়ের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যা কামাই সবই তো খরচ হয়ে যায়।’

মান ও পুষ্টিতে আপস করে খাদ্যের চাহিদা ও খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখে সীমিত আয়ের প্রতিটি পরিবার। কিন্তু বাড়িভাড়া, শিক্ষা, পরিবহন ও স্বাস্থ্য খাতে খরচে তাদের হাত নেই। এসব খাতে খরচে নিয়ন্ত্রণ নেই সরকারেরও।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে সাড়ে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ, পাঁচ হাজার বিদ্যালয়ের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণসহ নতুন নতুন স্কুল ভবন তৈরির জন্য বরাদ্দ রয়েছে। হাসপাতাল তৈরি, শয্যাসংখ্যা বাড়ানো, প্রায় ১০ হাজার ডাক্তার ও চার হাজার নার্স নিয়োগের কথা বলা হয়েছে বাজেটে। কিন্তু কোচিং ও গাইডের পেছনে খরচ, ডাক্তারের ফি ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার খরচসহ সার্বিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যয় কমানোর কোনো উপায়ের কথা নেই।

নতুন রোগ নিয়ন্ত্রণ, উন্নত ও দক্ষ ওষুধ খাত নিশ্চিত করার কথা ছিল বিদায়ী বাজেটে। জেনেরিক ওষুধ তৈরিতে ভারত বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়, তবু ওষুধের মান উন্নয়নে এ খাতে শতভাগ বিদেশি বিনিয়োগ উন্মুক্ত রয়েছে দেশটিতে। আর স্বাস্থ্যসেবায় মানুষের ব্যয় কমাতে পরীক্ষা-নীরিক্ষার খরচের ওপর কর কমানো, চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে করদাতাদের ১০ হাজার রুপি পর্যন্ত কর ছাড় দেওয়া ও বেসরকারি খাতে ১০০ শয্যা হাসপাতাল তৈরিতে কর অবকাশের প্রস্তাব রয়েছে সে দেশের নাগরিক সমাজের।

বেসরকারি চাকুরে মো. ইসহাক ফুসফুস ক্যান্সারে ভুগছেন। তিনি দেশে বেশ কিছুদিন চিকিৎসা নেওয়ার পর ছয় মাস ধরে ভারতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের শুধু চিকিৎসার খরচ ভারতে বিমানে যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসাসহ সব খরচের সমান। আর চিকিৎসার মানের ব্যাপারে আমি দেশের চেয়ে ভারতের চিকিৎসায় অনেক বেশি সন্তুষ্ট।’

অর্থবছর শেষ হচ্ছে ৩০ জুন, মেট্রো রেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে, তবে সমন্বিত একটি কর্তৃপক্ষের অধীনে নগরীর পরিবহন ব্যবস্থা এনে নিরাপদ গণপরিবহন ব্যবস্থা তৈরির কোনো উদ্যোগ নেই।

প্রাক্কলনের চেয়ে বেশি ধান ফলিয়ে এবার বিপদে পড়েছে কৃষকরা। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে ধান বিক্রি করতে পারেনি তারা। একজন কৃষি শ্রমিকের মজুরি দিতে দুই মণ ধান বিক্রি করতে হয়েছে। এবারের বাজেটেও কৃষি উন্নয়নের নানা পদক্ষেপের মধ্যে বিপণন সহযোগিতার কথাও ছিল, যদিও এর সুফল পায়নি ধান চাষিরা।

প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপারস (পিডাব্লিউসি) বাংলাদেশের ম্যানেজিং পার্টনার মামুন রশীদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভারতে বাজেট প্রণয়নে প্রচুর গবেষণা হয়, যা আমাদের দেশে অনুপস্থিত বললেই চলে। স্বাস্থ্য বীমা, শস্য বীমা, বেসরকারি খাতে পেনশন স্কিম নিয়ে কথা হলেও চালু হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে বাজেটকে আরো কল্যাণমুখী করতে হবে।’

অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) গবেষক ড. নাজনিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, কাজের বিনিময়ে অর্থ, নারীদের জন্য শিক্ষাবৃত্তিসহ বেশ কিছু ব্যতিক্রমী উদ্যোগ আছে। সামাজিক খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি বরাদ্দকৃত অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। শিশুরা যাতে লেখাপড়া বাদ দিয়ে শ্রমে না যায় তার জন্য উপযুক্ত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আরো বেশি বেশি নিতে হবে।’ তিনি বলেন, বেসরকারি খাতে সর্বজনীন পেনশন স্কিম, শস্য বীমা, সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য ভাতাসহ কল্যাণমূলক কর্মসূচি চালু করা দরকার। বর্তমান পরিস্থিতিতে করমুক্ত আয়সীমা ন্যূনতম তিন লাখ টাকা করা উচিত।

ভারতের বাজেটে সুরক্ষা আছে কৃষক, শ্রমিক ও মধ্যবিত্তের : প্রতিবেশী দেশ ভারতের বাজেটে মধ্যম ও সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ানোর উদ্দেশ্যে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতের বাজেটে করমুক্ত ব্যক্তিগত আয়সীমা আড়াই লাখ থেকে বাড়িয়ে পাঁচ লাখ রুপি করা হয়েছে। বছরে যাদের সাড়ে ছয় লাখ রুপি আয়, তারাও করমুক্ত থাকবে যদি তারা প্রভিডেন্ট ফান্ড ও নির্দিষ্ট কিছু ইক্যুইটিতে বিনিয়োগ করে। বেতনভুক্ত মানুষের জন্য স্ট্যান্ডার্ড ট্যাক্স ডিডাকশনের সুযোগ রাখা হয়েছে, যাতে বছরে ৫০ হাজার রুপি পর্যন্ত কর ছাড় পাওয়া যেতে পারে। এসব উদ্যোগের ফলে দেশটির মধ্যম ও নির্দিষ্ট আয়ের তিন কোটি মানুষ করের চাপ থেকে মুক্ত হয়ে বেঁচে যাওয়া অর্থ জীবন যাপনের প্রয়োজনে ব্যয় করতে পারবে।

বেসরকারি খাতের অসংগঠিত শ্রমিকদের পেনশনের জন্য ভারতের বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তারা মাসে তিন হাজার টাকা করে পেনশন পাবে। এর সুফল পাবে অনানুষ্ঠানিক খাতের ১০ কোটি শ্রমিক। দুই একর পর্যন্ত কৃষিজমি আছে এমন কৃষকরা বছরে ছয় হাজার রুপি আয় সহায়তা পাবে। এর ফলে ১২ কোটি কৃষক উপকৃত হবে। বিশ্বের বৃহত্তম স্বাস্থ্য পরিষেবা কর্মসূচি ‘আয়ুষ্মান ভারত’-এর মাধ্যমে দেশটির প্রায় ৫০ কোটি মানুষকে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া হবে। এরই মধ্যে প্রায় ১০ লাখ রোগী নিঃশুল্ক চিকিৎসা পরিষেবা পেয়েছে, যার জন্য তাদের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হতো। প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, কার্ডিয়াক স্টেন্ট এবং হাঁটু প্রতিস্থাপনের যন্ত্রাংশের দাম কমে যাওয়ায় লাখ লাখ দরিদ্র এবং মধ্যবিত্ত মানুষ উপকৃত হয়েছে।


সর্বশেষ খবর