বাঙ্গালীর বৈশাখ সংস্কৃতি
আবুল কালাম আজাদঃ পহেলা বৈশাখ, আবহমান বাংলার এক ঐতিহ্যিক ধারা। প্রতি বছর এ দিন বাংলার সকল শ্রেণীর মানুষের উপস্থিতিতে উদযাপিত হয় বাংলার সর্বোচ্চ ও মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক শোভাযাত্রা এবং নানা অনুষ্ঠানে অব্যাহত থাকে পুরো দিনটি। দিন বদলের পালায় পহেলা বৈশাখ এখন ধর্ম-বর্ণ, উঁচু-নীচু সব বৈষম্য দূরে রেখে বাঙালী জাতির মেল বন্ধনে এক ধরনের পোশাক-আচার-আচারণ ও শ্লোগানে উদ্বেলিত হয়ে দিনটি উদযাপিত হয়। বলা হচ্ছে বাঙালীয়ানা বা বাঙালী জাতিসত্তার ঐক্য সাংস্কৃতিক বিকাশ।
এ দিনে শুরুটা রমনা পার্কে হলেও মূল নেতৃত্বে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে ঢাকা মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দিকে যায়। বিজাতীয় সংস্কৃতির মূল প্রতিপাদ্য মঙ্গল প্রদীপ জ্বেলে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য শ্লোগানের পাশাপাশি বিভিন্ন পাপেট থাকে শোভাযাত্রার আগেভাগে। যেমন ময়ুর হুতুম পেচা হাতিঘোড়া সহ ভারতীয় সংস্কৃতির বিশেষ দিকগুলো বিশেষভাবে উল্লেখ থাকে। আর যারা এর নেতৃত্বে কর্তৃত্বে থাকেন তাদের পোশাক, আচার সম্পর্কে উল্লেখ করা দরকার। সাদা শাড়ী, লাল পাড়ের লালটুকটুক হতে হবে। হাতে থাকবে শাখা, কপালে থাকতে হবে রক্তিম সিঁদুরের আভা। কপালে অবশ্যই লাল ফোঁটা।
এরপর আবার পান্তা ইলিশ অবশ্যই প্রত্যুষে খেতে হবে। রমনা পার্কের পান্তা ইলিশের দোকানে বাংলার ললনাদের নিজ হাতে খাইয়ে দেয়ার ও স্বাদ গ্রহণ না করলে খাঁটি বাঙালী হওয়া যাবে না, বা এ দিনের কালচারের সাথে আপনি এক হতে পারবেন না। অর্থাৎ বাঙালী সংস্কৃতির মৌলিকত্ব আপনার মাঝে একভি’ত হলো না। রমনা পার্কের পান্তা খাওয়া ও হই হুল্লোড় করে একজনের গায়ে আরেকজন অথবা শাড়ী ব্লাউজ উড়ে যাওয়ার ইতিহাস পহেলা বৈশাখে প্রতি বছরই চমকপ্রদ খবর শোনা যায়। আনন্দ-উচ্ছ্বাসের নামে প্রতিবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অথবা রমনা পার্কে ঘুরতে আসা ছেলে-মেয়েদের আপত্তিকর ঘটনা প্রতিবারই ঘটে। বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে বৈশাখী মেলার পিছনে যাওয়ার আগে একটি বিষয়ে বলে নেয়া দরকার। তাহলো- সাম্প্রতিককালে বৈশাখ বা বৈশাখী মেলা এমন পর্যায়ে রূপ নিয়েছে যে, হিন্দু-মুসলমান-খৃস্টান-বৌদ্ধ সকল ধর্মের মানুষের প্রাণের মেলায় পরিণত হয়েছে। গত বছরও বৈশাখী মেলার যে উচ্ছ্বাস ও উন্মাদনা পরিলক্ষিত হয়েছে, তাতে বিশষজ্ঞজনের মতামত ও আগামীদিনের বাঙালী সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ বাণী এভাবে উল্লেখ করেছেন- “যে বাংলাদেশে এখন সর্বোচ্চ এবং সর্বস্তরের মানুষের প্রাণের মেলা হলো- বৈশাখী মেলা, এ মেলায় সকল ধর্মের-বর্ণের মানুষ এক হয়ে বাঙালী সংস্কৃতি উদযাপন করছে। যা ঈদ পার্বনের চেয়েও বৃহৎ আয়োজন এবং উপস্থিতির দিক দিয়েও সর্বাধিক।
দিন যতই যাচ্ছে বৈশাখী মেলা তথা পহেলা বৈশাখের কৃষ্টি-কালচার ভিন্নরূপে রূপান্তরিত হচ্ছে। মুসলিম সমাজের সবচে আনন্দ-উৎসবের জমকালো আায়োজন থাকে ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহার আচার অনুষ্ঠানকে ঘিরে। শুধু বাংলাদেশে নয়, এ উৎসব সারা পৃথিবীর মুসলিম সমাজের। অথচ বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখকে বর্তমান তথাকথিত বুদ্ধিজীবিদের চোখে সবচে বড় ও আদর্শিক বাঙালী সংস্কৃতি। যা অতি হতদরিদ্র ব্যক্তি ও বৈশাখের সাদা শাড়ী কিনতে বাদ পড়ছে না।
এ লেখাটি হাত দেবার আগে বাসার গৃহকর্মী ও রিক্সাওয়ালার কাছে জানতে চাইলাম তাদের এবারের বৈশাখের কেনাকাটা, বা পরিকল্পনা কি? জানা গেল- তারা এবারও বাচ্চাদের বৈশাখী কাপড় ও নিজেদেরও শাড়ী-পঞ্জাবী কিনবেন। তাদের মতে সবাই এ দিন নতুন জামা (সাদা কাপড়) পরিধান করে বৈশাখী সাজে চলে। আমরাও কম দামী হলেও কেনাকাটা করে থাকি। প্রকৃত পক্ষে বৈশাখী মেলার আমেজ এমন পর্যায়ে পড়েছে যে, সমাজের সাধারণ মানুষ বলতে অল্প আয়ের কেউ এর থেকে বাদ পড়ে না। ঠেলাগাড়ী, রিক্সাচালক, গার্মেন্টস কর্মী থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ স্তরের পেশাজীবি মানুষ পাগলপারা হয়ে বৈশাখী পোশাকের জন্য, উন্মাদ হয়ে কেনাকাটা করে। কিন্তু তারা আজও জানে না আদর্শ, এ আবেগ এ সংস্কৃতি কাদের, কেনইবা এ অর্থ ব্যয় করতে হবে।
পহেলা বৈশাখ নিয়ে জনসাধারণের মাঝে ক্রমান্বয়ে আগ্রহ বেড়ে চলেছে, তাদের কর্মকা- ক্রমেই একটি বিশেষ সংস্কৃতির পক্ষে প্রকাশিত হতে দেখা যাচ্ছে। একটু পিছন ফিরে দেখা যাক-
বাংলাদেশে বহু আগ থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠির সাথে অন্যান্য ধর্ম সম্প্রদায়ের লোকেরা মিলেমিশে উৎসবের আনন্দে মেতে উঠতো। কয়েক দশক আগেও সাধারণত নববর্ষ বলতে শুভ হালখাতা, গ্রামীণ মেলা ও কৃষকের আনন্দ উৎসবের বিভিন্ন অনুসঙ্গে মানুষ উচ্ছ্বাসে আমোদে আবেগে উদ্বেলিত হতো। সময়ের ব্যবধানে আশির দশক থেকে শহুরে পরিবেশে এ উৎসবের কছিুটা স্থান করে নেয়। তাতে শহরে তৃষ্ণার্ত মানুষের মনে মেলার মাধ্যমে কিছুটা হলেও সজীবতা ফিরে পায়। তাই রাজধানীসহ দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে এ মেলার প্রভাব প্রতিপত্তি ও আনন্দ উৎসবের কেন্দুবিন্দুতে পরিণত হয়। বৈশাখী মেলা এটা এ এমন বর্ষবরণ, মঙ্গল শোভাযাত্রার হাত ধরে একটি ধর্মীয় উৎসবের দিকে রূপান্তরিত হতে চলেছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, সম্রাট আকবর খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে বাংলার বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সম্রাটের আদেশ অনুযায়ী সে সময়কার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ আমীর ফাতেহ উল্লাহ সিরাজী সৌর বছর ও আরবী হিজরী সালের ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম তৈরীর কাজ শুরু করেন। বাংলা বছর নির্ধারণ নিয়ে লেখা বিভিন্ন বইয়ের প্রাপ্ত তথ্য মতে- ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে পরীক্ষামূলকভাবে এই গণনা পদ্ধতিকে কার্যকর করা হয় ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর থেকে অর্থাৎ সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহনের তারিখ থেকে। প্রথমে ফসলি সন বলা হলেও পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিতি পেতে শুরু করে। বস্তুতপক্ষে বৈশাখী মেলা বা ১লা বৈশাখে গ্রামীণ মানুষের মূল উপজীব্য আনন্দ, আমাদের মৌলিক প্রস্তুতি থাকে, যা পূর্বে ছিল। বর্তমান নগর জীবনে তার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে দারুণভাবে। আগের হালখাতার রূপবৈচিত্র ও নানানভাবে পাল্টে গেছে।
উপমহাদেশে প্রাচীন ভারতীয়রা দোল পূর্ণিমায় নববর্ষ উদযাপন করত। তাতে আনন্দ উৎসব একটা ধর্মীয় ভাব ছিল। বর্তমান যে আধুনিক নববর্ষ পালনের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বৃটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার আয়োজন করা হয়েছিল।
এরপরে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের প্রকাশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারির প্রতিবাদে ১৯৬৫ সালে অর্থাৎ ১৩৭৫ বঙ্গাব্দে ছায়ানট নামের একটি সংগঠন রমনা পার্কে পহেলা বৈশাখ বর্ষবরণ উৎসব পালনের আয়োজন করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এসো হে বৈশাখ.. এসে এস গানের মাধ্যমে তারা স্বাগত জানাতে শুরু করে নতুন বছরকে। বাংলাদেশে ছায়ানট নামে সংগঠনটির হাত ধরে বর্তমান আধুনিক মেলার পথ চলা। ১৯৭২ সালের পর হতে রমনার বটমূলে বর্ষবরণ জাতীয় উৎসবের স্বীকৃতি পায়। ১৯৮৩ সালে একইভাবে আরো কিছু উদ্যোগ নেয়া হয় বর্ষবরণের। এরপর ১৯৮৯ সালে বৈশাখী মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে আরো এক ধাপ এগিয়ে যায়। তবে মঙ্গল শোভাযাত্রা চারুকলায় ১৯৮৯ সালে পূর্ণরূপ পেলেও তার আগেও বাংলাদেশের অনেক স্থানে এর আত্মপ্রকাশ লাভ করে। ১৯৮৬ সালে চরুপাঠ নামের একটি প্রতিষ্ঠান যশোর হতে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে। এ শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, বাঘের প্রতিচ্ছবি, ময়ূরসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র ও শিল্পকর্ম।
প্রকৃতপক্ষে ১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলায় এই আনন্দ শোভাযাত্রা মঙ্গল শোভাযাত্রা হিসেবে নাম লাভ করে। ১৯৮৯ সালে প্রথম আনন্দ শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট-ঘোড়া-হাতি। ১৯৯০ সালে পরিবর্তিত নানান রূপে সজ্জিত হয়ে আরো আধুকিায়ন হতে দেখা যায় চারুকলাকে। ১৯৯১ সালে চারুকলার শোভাযাত্রা জনপ্রিয়তায় নতুন মাত্রায় এবং নানা ধরনের শিল্প প্রতিকৃতি যোগ করা হয়। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পী ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকরাও অংশ গ্রহণ করে। সেখানে বাঘ, পেঁচা, ঘোড়া, লক্ষিদেবীর প্রতিকৃতিও স্থান পায়।
এরপর ১৯৯৩ সালে ১৪০০ সাল উদযাপন কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রার আকর্ষণ ছিল বাঘ, হাতি, ময়ুর, ঘোড়া, বিভিন্ন ধরনের মুখোশ। নববর্ষ উপলক্ষে এতে যোগ হয় নতুন মাত্রা। মোটকথা ১৯৬৭ সালের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালন করা হয়নি। এরপর থেকে প্রতি বছরই বাড়তে থাকে পহেলা বৈশাখ বরনের আধিক্যতা। বর্ষবরণের এ উৎসবে শহরের পথে প্রান্তরে লাল-সাদা কমলার বন্যা সুতি শাড়ী, পাঞ্জাবী নারীর কপালে লাল-সবুজ টিপ, আর হালখাতার উৎসবে লাল প্রচ্ছদের আবহ। এছাড়া আয়োজনের তালিকায় লোকজ প্রান্তিক সংস্কৃতির সাথে অসাম্প্রদায়িক অনুষ্ঠানের মোড়কে হিন্দু ধর্মীয় অনুষ্ঠান।
এ দিনে নতুন হুল্লোড়ে আশ্বাসে ফের উদ্বেলিত হয় রবীন্দ্রনাথের জীবনানন্দ, অতুল প্রৃসাদ ও লালনের মানব দর্শন। বর্ষবরণের চিরায়ত সংস্কৃৃতির আধার খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রমনা পার্ক সাজ-সজ্জায় জমকালো হওয়ার সাথে রাজধানীর বিভিন্ন মাঠও হয়ে ওঠে সাংস্কৃতির বহুরূপি উন্মাদনা।
উপরোল্লিেখত আলোচনার প্রেক্ষিতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বৈশাখ নিয়ে বর্তমান যে মাতামাতি বা মুসলিম ও ইসলামী সংস্কৃতি নিয়ে যে আদিখ্যেতা দেখা যায়, তা বেশীদিনের নয়।অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে ভারতীয় বিজাতীয় সংস্কৃতির একটা গ্রুপ বা অনুসারী বাংলাদেশী সাধারণ মানুষের উপর পহেলা বৈশাখের নামে অপসংস্কৃতির একটা ছায়ারূপ মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। যার গতি-প্রকৃতি সারা দেশে বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা জানি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মূল অংশীদার সাধারণ মানুষ কৃষক-শ্রমিক জনতা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কখনো রাবিন্দ্রিক তাত্ত্বিকতা বা মঙ্গল প্রদীপের চেতনা ছিল না।
মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানো ভারতীয় আর্য সম্প্রদায়ের অর্চনা। এটা বাঙালী সংস্কৃতি নয়। এদেশে ছায়ানট ও উদিচি দুটি সাংস্কৃতিক সংগঠন তরা মঙ্গল প্রদীপ ও মঙ্গল শোভাযাত্রার ধারক ও বাহক। ১৯০৫ সালের বঙ্গবিভাগের মূল ভিত্তিও ছিল কালচারাল বিভাজন। আজ বাংলাদেশের স্বাধীন মানচিত্রকে ও মঙ্গল প্রদীপের আগুণে ভষ্মীভূত করার আয়োজন চলছে। এদেশ স্বাধীন মুসলমানদের দেশ। এখানে মঙ্গল প্রদীপের কালচার বৃহত্তর জনগনের কালচার হতে পারে না।
বাঙালী সংস্কৃতির নামে পহেলা বৈশাখে শাখা-সিঁদুরের যে সংস্কৃতি বা মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে বিজাতীয় ধারার পাপেট ও ময়ুর বাঘ-হাতি হুতুম পেঁচা সহ নানান প্রাণীর প্রতিকৃতি নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালী জাতির বা বাঙালী মুসলিম সংস্কৃতির পরিপন্থী। এ দেশের সাধারণ মানুষ অত্যন্ত আবেগী। সহজে আবেগপ্রবণ হয়ে মানুষের ভালবাসায় মুগ্ধ হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে নেপথ্যে খোঁজ না নিয়ে তারা সহজেই মিশে যায়। সে ক্ষেত্রে পহেলা বৈশাখের ব্যাপারেও দেশের মানুষ সহজিয়া হয়ে যায় আবেগে। তারা জানে না সাদা শাড়ী বা শাখা সিঁদুর কি রকম কালচার। তারা বোঝেনা মঙ্গল প্রদীপ জ্বালালে কি হয়। অনেকে অনুধাবন করতে পারে না মঙ্গল শোভাযাত্রা আসলে কি! সর্বোপপরি বৈশাখ নিয়ে দিনের পর দিন যে বল্গাহিন সংস্কৃতি ও নৈতিক মূল্যবোধের বিরোধী সংস্কৃতি আমাদের সমাজে ক্রমেই ক্যান্সার আকারে ধারণ করছে। তার ভবিষ্যৎ কি হতে পারে, তার উত্তর অনেকেই জানে না। ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর এক রকম আঘাতও বলা যায়। কারণ মঙ্গল শোভাযাত্রা মানেই ভারতীয় সংস্কৃতির পূর্ণাঙ্গ রূপ আমাদের সমাজে চাপিয়ে দেয়া, মঙ্গল শোভাযাত্রা অর্থই দেশী সংস্কৃতিকে বিভাজন করা, বা হিন্দুয়ানা সব দিকনির্দেশনা মেনে বিজাতীয়তাবোধকে আত্মস্থ করা। এ ব্যাপারে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষকে আরো সচেতন হতে হবে। মহান প্রভুর দেয়া আমাদের বিবেকবোধকে আরো চৌকস ও সময়োপযুগি করে অত্যাধুনিক যুগের পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা অনুধাবন করা সময়ের অনিবার্য দাবী। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ মঙ্গল প্রদীপের কালচারকে লালন বা স্বীকার করতে পারে না। মাটি ও মানুষের চেতনার সাথে মঙ্গল প্রদীপের কোন সংশ্রব নেই। হি ন্দুদের ধর্মীয় আচারকে যারা সংস্কৃতির উপকরণ উপাচার বলে মনে করেনকেমন ধরণের, সেটা বুঝতে বাকী থাকে না। সিঁদুর সংস্কৃতি, ধুতি, লাল পেড়ে শাড়ীর মনিহারি সম্মিলনে পান্তা খাবার ঢেঁকুর তোলার কিংবা রাধাকৃষ্ণের বৃন্দাবনী ঢং-এ বসন্তবরণ কখনো বাঙালী মুসলমানদের কালচার হতে পারে না। আল্পনা আঁকা, মূর্তি পূজা ও বাঙালী মুসলমানদের কালচার নয়। প্রকৃতপক্ষে এপার বাংলা ওপার বাংলার বাংলা ভাষাভাষী হলেই যে একই কালচারের সম্মিলন ঘটবে, তা কখনো হতে পারে না। কিন্তু পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানে মূল সুর হচ্ছে বাঙালী ভাষী মানেই সব এক। যার বাস্তবতা ইতিহাসেও নেই, আগামীতেও এ জাতীয় চিন্তা ও আনুষ্ঠানিকতা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের ন্যায় কালচারাল দূরভিসন্ধি বটে।
একই ভাষার জাতক বাঙালীদের দুটি আলাদা রাষ্ট্রের অধিবাসী। ভাষার প্রকৃতি ও আবেদনের ৃচেয়ে সাংস্কৃতিক প্রভাব আরো ব্যাপক ও গভীরতর। আবুল মনসুর আহমেদ লিখেছেন-
“একদিকে ভাষার ঐক্য ছড়াইয়া কানাডা ও সুইজারল্যান্ডের মতো রাষ্ট্র জাতিতে পরিণত হইয়াছে, অপরদিকে শুধু ভাষা মানবগোষ্ঠীকে এক রাষ্ট্র জাতি রাখিতে পারিতেছে না। একই ভাষাভাষীরা আজ ভিন্ন রাষ্ট্র জাতিতে পরিণত হইতেছে। আরব রাষ্ট্রসমূহ এবং ইংল্যান্ড ও আমেরিকা তার প্রমাণ। বাংলাদেশ তার আধুনিক প্রুমাণ। জনগণের স্তরে বাংলায় দুটি কৃষ্টি ছিল: একটা বাঙালী হিন্দু কালচার, অপরটা বাঙালী মুসলিম কালচার”। (বাংলাদেশের কালচার: আবুল মনসুর আহমদ)
যে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এপার বাংলা ওপার বাংলা একাকার করে মঙ্গল প্রদীপের মঙ্গলালোকে আমাদের অভিষিক্ত করে কৃতার্থ করতে চান, সেই রবীন্দ্রনাথই লিখেছেন- “বাংলাদেশের ইতিহাস খ-তার ইতিহাস। পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ, রাঢ় বরেন্দ্রের ভাগ কেবল ভূগোলের ভাগ নয়, অন্তরেরও ভাগ। সমাজেরও মিল নাই। এতকাল যে আমাদের বাঙালী বলা হয়েছে, তার সংজ্ঞা হচ্ছে, আমরা বাংলা বলে থাকি।” (ভাষা ও সাহিত্য: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-১৯৩৯)
আবুল মনসুর আহমদ আবার লিখেছেন- “পাঠান মোগলদের আগমনকে রবীন্দ্রনাথ বিদেশী আক্রমণ বলিলেও ৃআর্য আগমনকে তা বলেন নাই, রবীন্দ্রনাথথের ভারত তীর্থ ঐখানে।
আবুল মনসুর আহমদ আরো লিখেছেন, “বাংলার মানুষের সমাজ একটা নয়, দুইটা। সেই দুইটা সমাজ এক্সক্লুসিভ। তাদের মধ্যে খাওয়া-পরা, বিবাহ-শাদী ইত্যাদি সামাজিক মিল নাই। তাই এগারশ বছর এক দেশে বাস করিয়া একই খাদ্য পানীয় খাইয়াও তারা দুইটা পৃথক সমাজ রহিয়া গিয়াছে। এক সমাজের লোক জন্মিয়া খৎনা করিয়া নিজস্ব সমাজে বাস করিয়া মরিয়া গোরস্তানে যায়, অপর সমাজের লোক অশৌচান্ত ও উপনয়ন করিয়া নিজের সমাজে বাস করিয়া মৃত্যুর পর শ্মশানে যায়। ফলে এই দুইটা সমাজে দুইটা প্যারালাল কালচার গড়িয়া উঠিয়াছে। জাতীয় কালচার গড়িয়া ওঠে নাই। বাংলা ভাগের মধ্যে এই দুইটা কালচার নিজ নিজ আশ্রয়স্থল খুঁজিয়া পাইয়াছে।”
বাস্তবিকপক্ষে একই ভাষায় কথা বললে দেশজ সংস্কৃতি ও দেশাত্ববোধ কোনদিন এক হতে পারে না। শুধু বৈশাখী মেলার মাধ্যমে আমাদের জাতীয়তাবোধের সংস্কৃতি আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত করা ছাড়া অন্য কোন জায়গায় ঠাঁই নেই। বাঙালী সংস্কৃতির মধ্যে কোন অপসংস্কৃতি ও রুচিহীন আচার থাকতে পারে না। এ দেশের মানুষ তাদের লোকজ ও দেশজ মৌল সংস্কৃতিকে বিশ্বাস করে। যেমনিভাবে পহেলা বৈশাখ নতুন দিনের উদ্ভাসনে নতুনত্বের সূচনা করে, বাংলার মানুষের মেধা-মনন, চিন্তা-চেতনা ও অত্যন্ত সুন্দর ও অনুপম। বৈশাখীর নব তরুর সবুজ সুন্দর যেন প্রকৃতিকে সৌন্দর্যম-িত ও আন্দোলিত করে, তেমনিভাবে এ দেশের মানুষের মৌলিক মানবিক দিক আরো সুন্দর ও রুচিশীল সংস্কৃতিবোধে বলিয়ান হোক। এটাই সবার চাওয়া ও পাওয়া। বৈশাখীতে যেন শুধু কালবৈশাখীর আনাগোনা না দেখা যায়। সেখনে ফুটে উঠুক অনিন্দ্য সুন্দরের আগামী। যদি বৈশাখী প্রকৃতিকে আঘাত করে, সেটাও হয়ত নতুনভাবে গড়ে তোলা, বা নতুন করে প্রকৃতিকে রূপ দান করে সজীবতা আনতে, ধ্বংস করতে নয়।
বাঙালীর বৈশাখ হোক সেই সুন্দর ও আনন্দের ধারক-বাহক। এবং সুস্থ ও রুচিশীল সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকুক সবার জীবনে।
লেখকঃ কলাম লেখক, প্রাবন্ধিক ও গবেষক।