রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত তিন এমডির আমলে নজিরবিহীন লুটপাট
ডেস্ক রিপোর্টঃ সোনালী ব্যাংকে ‘রাজনৈতিক’ বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া তিন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) আমলে নজিরবিহীন লুটপাট হয়েছে। এই তিন এমডিই বর্তমানে দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনের বেড়াজালে।
তারা হলেন বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এম তাহমিলুর রহমান, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে হুমায়ুন কবির এবং একই আমলের প্রদীপ কুমার দত্ত। এম তাহমিলুর রহমান দুদকের মামলায় কিছুদিন কারাগারে ছিলেন। হুমায়ুন কবির একাধিক মামলার আসামি হয়ে এখন দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।
প্রদীপ কুমার দত্তের সময়ের অনিয়মের বিষয়ে এখন তদন্ত চলছে। বর্তমান এমডি মো. ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ গত বছরের ২৮ আগস্ট ব্যাংকে যোগ দিয়ে লুটপাটের কারণে সরকারি খাতের ব্যাংকটির খোয়া যাওয়া অর্থের হিসাব করছেন। একই সঙ্গে ব্যাংকটিকে ঘুরে দাঁড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছাড়া অন্য কিছু করার নেই। বেশিরভাগ অপরাধের কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলেও তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এসব অপরাধের জন্য আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি আরও বলেন, অনেক সময় অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় তারা অন্য ব্যাংকে নতুন করে নিয়োগ পান। আর এ দায়ভার বেশিরভাগই পড়ে প্রস্তাবিত ব্যাংকের ওপর। এখন ব্যাংকের এমডি নিয়োগ এবং তাদের কার্যক্রম কঠোরভাবে তদারক করা দরকার।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, এমডি নিয়োগ বা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়গুলো দেখাশুনার কাজ করেন বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ডিভিশন। এসব বিষয়ে তারাই ভালো বলতে পারবেন।
সূত্র জানায়, ওই তিন আমলে সোনালী ব্যাংক থেকে কমপক্ষে সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। এর মধ্যে এম তাহমিলুর রহমান ২০০৪ থেকে ২০০৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। তার সময়ে সোনালী ব্যাংকের কয়েকটি শাখায় বড় ধরনের লুটপাট হয়।
এর মধ্যে ব্যাংকের রমনা করপোরেট শাখায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। ওই সময়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বড় ভাই প্রয়াত সাঈদ এস্কান্দারের কোম্পানিসহ সরকারের ঘনিষ্ঠ মহল ঋণ নেয়। ওইসব ঋণ এখন খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত।
এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয় থেকে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের পরিচয়ে ১০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে খেলাপি হন মাস্ক গ্রুপের কর্ণধার আক্রাম হোসেন। ওই ঋণও এখন খেলাপি। এ ছাড়া একই শাখা থেকে বিএনপির আরও কয়েক নেতা ওই সময়ে ঋণখেলাপি হয়েছেন।
এ ছাড়া এম তাহমিলুর রহমানের আমলে বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স সংগ্রহের নামে বিভিন্ন এজেন্ট নিয়োগ করে ব্যাংক। এদের কাছ থেকে বাজার দরের চেয়ে বেশি দামে ব্যাংক ডলার কিনেছে। ফলে সোনালী ব্যাংকের লোকসান হয়েছে প্রতি ডলারের ২০ থেকে ৩০ পয়সা। কখনো আরও বেশি। ওই ধারাবাহিকতা পরবর্তী সময়েও চলমান রয়েছে।
পেশাদার ব্যাংকার না হয়েও শুধু প্রভাব খাটিয়ে সোনালী ব্যাংকের এমডি হন মো. হুমায়ুন কবির। তিনি ছিলেন সরকারি প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) এমডি। সেখান থেকে তিনি আসেন সোনালী ব্যাংকের এমডি পদে।
এর আগে তিনি বড় কোনো ব্যাংকের এমডি বা ডিএমডি ছিলেন না। ২০১০ সালের ২০ মে থেকে ২০১২ সালের মে পর্যন্ত ছিল তার মেয়াদ। মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই তাকে ব্যাংক থেকে বিদায় নিতে হয়। হল-মার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় তিনি ছিলেন প্রধান অভিযুক্ত। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে এই ঘটনা ধরা পড়ার পর তাকে অপসারণ করা হয়।
ওই সময়ে সোনালী ব্যাংকের শেরাটন হোটেল শাখা থেকে হল-মার্ক গ্রুপ প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করে। এটিই ছিল বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে সবচেয়ে বড় জালিয়াতি। ওই জালিয়াতির ঘটনায় তিনি দুদকে হাজিরাও দিয়েছেন। বর্তমানে কানাডায় পালিয়ে গেছেন। এ ছাড়া ওই সময়ে সোনালী ব্যাংকের আরও কয়েকটি শাখায় বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ঘটে।
এর পর ২০১২ সালের ১৭ জুন ব্যাংকের এমডি হিসেবে দায়িত্ব নেন সোনালী ব্যাংকেই দীর্ঘ সময় কাজ করা প্রদীপ কুমার দত্ত। তিনি এর আগে একই ব্যাংকের ডিএমডি, জিএম, ডিজিএম, এজিএম ছিলেন।
তিনি টানা ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তার মেয়াদ বাড়ানো হয় দুই দফা। তিনি এমডি থাকার সময়ে ব্যাংকের অনেক খেলাপি গ্রাহক বেআইনি ঋণ সুবিধা পেয়েছেন। এ ছাড়া ব্যাংকের শিল্প ভবন শাখা, দিলকুশা বৈদেশিক বাণিজ্য শাখা, স্থানীয় কার্যালয়, চট্টগ্রামের লালদিঘির মোড় ও আগ্রাবাদ শাখায় বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। এসব জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকের হাতছাড়া হয়েছে।
সোনালী ব্যাংকে ওই আমলেই সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এমডিকে নানা সুবিধা দিয়ে প্রভাবিত করে একেবারে ‘শূন্য ঘরে’ প্রায় ৫০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন সোনারগাঁও উপজেলার আল আমরিন গ্রুপ। ওই সময়ে অনেকটা পানির মতো ঋণ দেওয়া হয়েছে ব্যাংক থেকে। যে কারণে ওইসব ঋণ এখন আদায় না হয়ে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
ব্যাংক পরিচালনার নীতি প্রণয়ন করে পর্ষদ এবং সেই নীতি বাস্তবায়ন করে এমডির নেতৃত্বে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। ফলে ব্যাংকে বড় ধরনের কোনো দুর্নীতি হলে এই দুই স্থানেই দায়ভার আসার কথা। কিন্তু ওইসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত শুধু সাবেক এমডি হুমায়ুন কবিরকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। বাকি এমডিদের ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয় বা বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা আমাদের সময়কে বলেন, কোনো এমডির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তদন্ত করে তাকে তার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নতুন করে অভিযুক্তকে অন্য কোনো ব্যাংকে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। অভিযুক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দুর্নীতির মাত্রা কেমন তা আগে থেকে দেখা হয়। যদি অভিযুক্ত আইনিভাবে বিচারের মধ্যে থাকে তাকে অবশ্যই নতুন করে কোনো ব্যাংকে নিয়োগ দেওয়া হয় না।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক অভিযুক্তকে তার পদ থেকে সরিয়ে দিতে কিছু আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এর বাইরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু করার নেই। এই ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত প্রতিবেদন দুর্নীতি দমন কমিশনের বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে পাঠিয়ে দেয়। পরে তারা এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়। তাই অভিযুক্তের অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব তাদের নয়। এখানে ব্যাংকের কিছু করার নেই।
সূত্র জানায়, সরকারি ব্যাংকগুলোয় এমডি নিয়োগ করে অর্থ মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ ব্যাংক দেয় ছাড়পত্র। তারা নিয়োগ প্রক্রিয়ার সময়ে এমডিদের নৈতিকতার বিষয়গুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে না বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে রাজনৈতিক বিবেচনায় তারা এমডি পদে নিয়োগ পেয়ে যাচ্ছেন।
(সূত্র-আমাদের সময়)