মুকুটহীন সম্রাট শিল্পি এস এম সুলতানের ২৪তম মৃত্যু বার্ষিকী আজ
সৈয়দ হাসান ইকবালঃ নড়াইলের গৌরব বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের জন্ম ১০ আগষ্ট ১৯২৩ নড়াইল জেলার সদর উপজেলার মাছিমদিয়া গ্রামের এক কৃষক পরিবারে। তাঁর ডাকনাম লাল মিয়া। ছোটবেলায় সকলে তাকে লাল মিয়া বলেই ডাকতো। শিল্পি জীবনের মূল সূর-ছন্দ খুঁজে পেয়েছিলেন বাংলার গ্রামীণ জনপদের মাটি ও মানুষ তথা কৃষক, কৃষিকাজ ও প্রকৃতির মধ্যে। আবহমান বাংলার সেই ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিপ্লব-সংগ্রাম এবং বিভিন্ন প্রতিকুলতার মধ্যেও টিকে থাকার ইতিহাস তাঁর শিল্পকর্মকে সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত করেছে। শিল্পির চিত্রে গ্রামীণ জীবনের পরিপূর্ণতা, প্রাণ প্রাচুর্যেরে পাশাপাশি শ্রেণী দ্বন্দ্ব ও গ্রামীণ অর্থনীতির রূপ অনেকটাই ফুটে উঠেছে। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বাংলাদেশের গ্রামীণ প্রকৃতিকে ।
শত দারিদ্র, শত বাধা থাকা সত্ত্বেও ১৯২৮ সালে সুলতানের পিতা তাঁকে নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। পাঁচ বছর পর থেমে যায় পড়াশোনা। এরপর বাবার সঙ্গে রাজমিস্ত্র্রীর কাজ ধরেন। এভাবেই এসএম সুলতানের কর্মজীবন শুরু। চলতে থাকে বিভিন্ন দালানে দালানে ছবি আঁকা। দশ বছর বয়সের স্কুল জীবনে, স্কুল পরিদর্শনে আসা ডা. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর ছবি এঁকে সবার তাক লাগিয়ে দেন। দরিদ্র ঘরের সুলতানের ইচ্ছে ছিল কলকাতায় গিয়ে ছবি আঁকা শিখবেন। এ সময় তাঁর প্রতিভায় চমৎকৃত হয়ে স্থানীয় জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায় তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসেন। ১৯৩৮ সালে এস এম সুলতান কলকাতায় গমন করেন। সুলতানের শিক্ষার জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাঁর গ্রন্থাগারের দরজা উন্মুক্ত করে দেন।
১৯৪১ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সহযোগিতায় তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। তিন বছর আর্ট স্কুলে পড়ার পর ফ্রিল্যান্স শিল্পির জীবন শুরু করেন। কোলকাতা আর্ট স্কুলের বাঁধাধরা জীবন সুলতানের ভাল লাগেনি। তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা ও ভবঘুরে প্রকৃতির। সেজন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার নিয়মনীতি তিনি মেনে নিতে পারেননি। তিনি ছিলেন প্রকৃতিপ্রেমী একজন আবেগী মানুষ। সেজন্য তিনি অস্বীকার করেছিলেন যান্ত্রিকতাপিষ্ট নগর ও নাগরিক জীবনকে। ১৯৪৩ সালে তিনি ব্রিটিশ ভারতের ‘খাকসার আন্দোলনে’ যোগ দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তিনি বেরিয়ে পড়েন উপমহাদেশের পথে প্রান্তরে । ছোট বড় শহরগুলিতে ইংরেজ ও আমেরিকান সৈন্যদের ছবি আঁকতেন। ছবি প্রদর্শনী ও ছবি বিক্রি করে চলত তাঁর জীবন। শিল্পি হিসেবে তিনি তখন কিছুটা পরিচিতি লাভ করেছিলেন।
জাগতিক বিষয়ের প্রতি ছিল সুলতানের প্রচন্ড অনাগ্রাহ। শিকড় ছড়াবার আগেই তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন। আর সেজন্য তখনকার আঁকা তাঁর ছবির এমনকি ফটোগ্রাফও এখন আর নেই। সে সময় তিনি নৈসর্গিক দৃশ্য ও প্রকৃতির ছবিও আঁকতেন। কাশ্মীরে কিছুদিন থেকে তিনি প্রচুর ছবি এঁকেছিলেন। সিমলায় ১৯৬৪ সালে তাঁর আঁকা ছবি প্রথম প্রদর্শনী হয়। ১৯৪৭ সনে ভারত-পাকিস্তান বিভাগের পর কিছু দিনের জন্য এস এম সুলতান জন্মস্থান নড়াইলে ফেরেন। কিন্তু এর পরই ১৯৫১ সালে তিনি করাচি চলে যান। সেখানে পারসি স্কুলে দু’বছর শিক্ষকতা করেন। সে সময় চঘুতাই ও শাকরে আলীর মত শিল্পিদের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। তার পূর্বে ১৯৫০ সালে তিনি আমেরিকায় চিত্রশিল্পিদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেন এবং নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, শিকাগো, বোস্টন ও পরে লন্ডনে তাঁর ছবির প্রদর্শনী করেন। নড়াইলে তিনি নন্দ কানন নামের একটি প্রাইমারী ও একটি হাই স্কুল এবং একটি আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। শিশুদের জন্য কিছু করার জন্য আগ্রহ থেকের শেষ বয়সে তিনি ‘শিশুস্বর্গ’ ও ‘চারুপীঠ’ প্রতিষ্ঠা করেন।
এস এম সুলতান পঞ্চাশ দশকে ঢাকায় আধুনিক চিত্রকলা নিয়ে প্রচুর কাজ শুরু করেন। সে সময় শিল্পিরা উৎসাহ ও আগ্রহে বিভিন্ন কৌশল-রীতি, নিয়ম ও ছবির মাধ্যমসহ নতুন নতুন বিভিন্ন ক্ষেত্রের পরীক্ষা নিয়ে প্রচুর ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সে সময়ও এস এম সুলতান সকলের চোখের আড়ালে নড়াইলেই রয়ে গেলেন। মাঝে মাঝে ঢাকায় আসতেন কিন্তু তাঁর জীবনের মূল সুরটি ছিল গ্রামীণ জীবন, কৃষক ও কৃষিকাজের ছন্দের সঙ্গে বাঁধা। গ্রামীণ জীবন থেকেই তিনি আবিষ্কার করেছেন বাঙালি জীবনের উৎস কেন্দ্রটি, বাঙালির দ্রোহ ও প্রতিবাদ, বিল্পব ও সংগ্রাম, নানান প্রতিকুলতার সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার ইতিহাস ও অনুপ্রেরণা। গ্রামীণ জীবনেই তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন বাঙালির ইতিহাস, সংস্কৃতি। তিনি কৃষক পুরুষকে দিয়েছেন পেশীবহুল ও বলশীল দেহ। আর কৃষক রমণীকে দিয়ছেন সুঠাম ও সুডৌল গড়ন, দিয়েছেন লাবণ্য ও শক্তি। হয়তো তাঁর দেখা দুর্বলদেহী, ম্রিয়মান ও শোষণের শিকার কৃষকদের দেখে কল্পনায় তিনি নির্মাণ করেছেন শক্তিশালী ও স্বাস্থ্যবান কৃষক সমাজ।
সুলতানের ছবিতে পরিপূর্ণতা ও প্রাণপ্রাচুর্যের পাশাপাশি ছিল শ্রেণী বৈষম্য, গ্রামীণ জীবণের কঠিন বাস্তবতার চিত্র। তাঁর আঁকা চরদখল (১৯৭৬) ও হত্যাযজ্ঞ (১৯৮৭) এরকমই দুটি ছবি। তাঁর সৃজনশীলতার শুরু থেকে ছবির মূল বিষয় ছিল প্রকৃতি। মধ্য পঞ্চাশের পর থেকে তার কাজে পরিবর্তন আসে। পল্লী বাংলার ল্যান্ডস্কেপ করতে থাকেন। তাঁর-ল্যান্ডস্কেপে এলো ফসলের জমি, বাংলার কৃষি জীবন এবং শ্রমজীবি মানুষ। ষাটের শেষে তার পরীক্ষা-নীরিক্ষা এবং অর্জিত অভিজ্ঞতা কাজে মূর্ত হতে থাকে। তাঁর চিত্রকর্মের প্রধান উপজীব্য বিষয় হয়ে উঠলো মানুষের দেহাবয়ব। পরে ল্যান্ডস্কেপের পরিবর্তে মানুষই হয়ে উঠে তার ছবির অধিপতি।
পৃথিবীর ইতিহাসে মানব সভ্যতার যাত্রা শুরু হয় কৃষিকর্ম থেকে। কৃষি-জমি ফলিয়ে আবাদ করা মানুষেরাই ভারতবর্ষে, চীন, মেসোপটেমিয়া, , ব্যাবিলনে সভ্যতার জয়ডঙ্কা বাজিয়ে ছিলেন প্রথম। সেখানেই ইতিহাস গতি পেয়েছে। ইতিহাস-নির্মাতা এই কর্মী কৃষকরাই শেষ পর্যন্ত সুলতানের ছবির নায়ক। সুলতানের আঁকা মানুষেরা সেজন্য বাংলাদেশের হয়েও সমস্ত পৃথিবীর মানুষ। এ বিষয়ে আহমদ ছফার একটি লেখা থেকে উদ্ধৃতি….‘প্রকৃতি ফুটন্ত ইতিহাসের গভীরতম অঙ্গীকার যারা নিরবধিকাল ধরে বহন করে চলেছে, নতুন ফুটন্ত ইতিহাসের আবেগ-উত্তাপ সবটুকু পান করে ফুটে উঠবার বীর্য এবং বিকাশমান সৃষ্টিশীলতা যাদের আছে। সেই শ্রমজীবী কিষাণ জনগণকে তিনি বাংলার ইতিহাসের নবীন কুশীলব হিসেবে দেখতে পেয়েছিলেন। সুলতানের কৃষক নেহায়েত মাটির করুণার কাঙ্গাল ছিলেন না। সুলতানের কৃষকেরা জীবনের সাধনায় নিমগ্ন। তারা মাটিকে চাষ করে ফসল ফলায় না। পেশীর শক্তি দিয়ে প্রকৃতির সাথে সঙ্গম করে প্রকৃতিতে ফুলে-ফসলে সুন্দরী সন্তানবতী হতে বাধ্য করে। এখানে জীবনের সংগ্রাম এবং সাধনা, আকাঙক্ষা এবং স্বপ্ন, আজ এবং আগামী কালের একটি বিন্দুতে এসে মিশে গিয়েছে।
শিল্পি সুলতান ছিলেন অসাধারণ প্রতিভার অধিকারি। তাঁকে নড়াইলের মানুষ তথা বাংলাদেশের মানুষ শুধু চিত্র শিল্পি হিসেবে স্মরণ করবে না, বরং জীবনঘনিষ্ঠ, মৃত্তিক সংলগ্ন এক স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবেও মনে রাখবে-যাঁর স্বপ্ন ছিল জীবনের শিল্পের প্রতিফলন ঘটানো। সুলতানের ভালবাসা ছিল মানুষের প্রতি, বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষের এবং কৃষকের প্রতি। এদেশের কৃষকেরা নিরন্ন, কৃষককে তিনি এঁকেছেন অমিত ব্যক্তিধর, বলশালী মানুষ হিসেবে। সুলতান ছিলেন প্রকৃতি প্রেমী-বাংলাদেশের আবহমান সবুজ, সতেজ প্রকৃতি তাঁর তুলিতে অমর হয়েছে। তিনি ছিলেন প্রাণী প্রেমিক-বনের পশুপাখি সাপখোপের প্রতি ছিল তাঁর অকাতর ভালবাসা। আর সুলতান ছিলেন শিশুদের অকৃত্রিম বন্ধু। নড়াইলের চিত্রা নদীর তীরে তাঁর আবাসস্থলে গড়ে তোলা ‘শিশুস্বর্গ’ আর চিত্রা নদীতে ভাসমান বিশাল নৌকাটি ওই বন্ধুত্ত্বের দু’টি প্রতীক।
এসএম সুলতান ১৯৮০ এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের কাছ থেকে শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫১ই সনে নিউইয়র্কে, ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে তদানিন্তান পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে অংশ গ্রহণ করেন। এছাড়াও ১৯৮১ সনে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে আন্তর্জাতিক জুরী কমিটির অন্যতম সদস্য মনোনীত হন।তিনি ১৯৮২ সালে একুশে পদক, ১৯৯৪ সালে স্বাধীনতা পদক ও ১৯৮৫ সালে চারুশিল্পী সংসদ সম্মানে ভূষিত হন।
নড়াইলের গর্ব বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পি এসএম সুলতান আধুনিকতার একটি নিজস্ব সংজ্ঞা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর তেমন কোন অনুসারী ছিলো না যারা একই সংজ্ঞা মেনে শিল্পচর্চা করতেন। এ কারণেই তাঁর প্রতিষ্ঠিত আধুনিকতার স্বরূপ নিয়ে নতুন কোন ধারার সৃষ্টি হয়নি। কেউ তাঁর মতো করে আধুনিকতার ব্যাখ্যাও দেননি। এছাড়াও তাঁর মতো মাটির জীবন তখনকার কোনো শিল্পি যাপন করেননি। তাঁর কাছে আধুনিকতার সংজ্ঞা কেমন ছিলো তা বলতে গিয়ে বাংলাপিডিয়ার তাঁর জীবনী লেখক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লিখেছেন “তাঁর কাছে অবয়বধর্মিতাই প্রধান। তিনি আধুনিক, বিমূর্ত শিল্পের চর্চা করেননি, তাঁর আধুনিকতা ছিলো জীবনের শাশ্বতবোধ ও শিকড়ের প্রতিষ্ঠা করা। তিনি ফর্মের নিরীক্ষাকে গুরুত্ব দেননি, দিয়েছেন মানুষের ভেতরের শক্তির উত্থানকে, ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই এবং ঔপনিবেশিক সংগ্রামের নানা প্রকাশকে তিনি সময়ের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপন করেছেন। এটাই তাঁর কাছে ছিলো “আধুনিকতা” অর্থাৎ তিনি ইউরো কেন্দ্র্র্রীক, নগর নির্ভর যান্ত্রিকতা-আবদ্ধ আধুনিকতার পরিবর্তে অন্বেষণ করেছেন অনেকটা ইউরোপের রেনেসাঁর শিল্পীদের মতো মানবের কর্ম বিশ্বকে।”
মাটি,মানুষ ও প্রকৃতি শিল্পি এসএম সুলতান তার শেষ জীবনে বলে গিয়েছেন- “আমি সুখী। আমার কোন অভাব নেই। সকল দিক দিয়েই আমি প্রশান্তির মধ্যে দিন কাটাই। আমার সব অভাবেরই পরিসমাপ্তি ঘটেছে।” এসএম সুলতান ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসাপাতালে ৭১ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। সুলতান লোকান্তরিত হয়েছেন কিন্তু যারা অমর হওয়ার জন্য জন্মান তাদের যথার্থ মৃত্যু কোনদিন হয় না। বাংলাদেশের রূপকারদের মধ্যে জয়নুল, কামরুল এর সংগে আর একটি নাম সব সময় উচ্চারিত হবে- যিনি মুখে সোনার চামচ নিয়ে জন্মান নি। তিনি হলেন নড়াইলের তথা বাংলাদেশ সকলের গর্ব মুকুটহীন সম্রাট এস এম সুলতান।
লেখক লেঃ কর্ণেল সৈয়দ হাসান ইকবাল (অব.